শীত আসতে না আসতেই রাজধানীতে ধুলা বেড়েছে। মেট্রোরেল, রাস্তা-ঘাট চওড়াসহ নানা ধরনের নির্মাণ কাজে মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহাবাগ, প্রেসক্লাব, পল্টন ও মতিঝিলের অনেক এলাকা এখন ধুলাময়। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এসব এলাকার প্রধান সড়কে পানি ছিটানো হলেও খুব একটা কাজে দিচ্ছে না।
মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) কারওরান বাজারে বাসচালক মনির বলেন, ধুলায় রাস্তা-ঘাটে গাড়ি চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। গাড়িতে ধুলা-ময়লা থাকলে যাত্রী উঠতে চায় না। আমরা প্রতি ট্রিপ শেষ করেই গাড়ি পরিষ্কার করি। কিন্তু বাস রাস্তায় নামলেই ধুলায় ভরে যায়।
পরিবেশবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, মেগা প্রজেক্টগুলো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম থাকছে উপেক্ষিত।
বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আইকিউ এয়ারের ওয়বেসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বাতাসের মান ২২১ নিয়ে দূষিত শহরের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা। বাতাসের মান ২৬০ স্কোর নিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে কিরগিজস্তানের বিশকেক এবং ১৯১ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি।
পরিবেশবিদরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বায়ুর মান অত্যন্ত খারাপ। অন্যান্য সময়ের তুলনায় রাজধানীতে ধুলাবালির পরিমাণও বেড়েছে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালে ডিসেম্বরে প্রায় ২০ ভাগ বায়ুদূষণ বেশি হয়েছে। গত বছরে ডিসেম্বরে বায়ুর মান ছিল ১৮৩, এই বছরে ডিসেম্বরে বায়ুর মান ২৩২ চলে গেছে। গত বছরের তুলনায় এই বছর বায়ুর মান ২০ ভাগের মতো বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, এ বছরের ডিসেম্বরের ৬ তারিখে সবচেয়ে বেশি খারাপ ছিল ঢাকার বায়ু। এদিন বায়ুর মান ছিল ৩১০। এই বছরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ গত ৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত ছিল। যদি তাপমাত্রা ও বায়ুর গতিপ্রবাহ না বাড়ে তাহলে এটি আরও বাড়তে পারে।
রাজধানীর বায়ু এত দীর্ঘ সময় ধরে খারাপ থাকে না উল্লেখ করে ড. কামরুজ্জমান বলেন, এটা এমন দীর্ঘ সময় কোনো দিন ছিল না। বিগত ৪-৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণত পুরো বছরে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি— এই চার মাসে চার থেকে পাঁচবার বেশি এমন পরিবেশ তৈরি হয়। সেটা ৫ থেকে ৬ দিন অবস্থান করে। কিন্তু এবার দেখা গেছে, এ পরিস্থিতি ১০ থেকে ১২ দিন অবস্থান করছে।
তিনি বলেন, সাধারণত বে অব বেঙ্গল থেকে বা দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হয়। সমুদ্র থেকে বাতাস আসায় সেই বাতাসটা বিশুদ্ধ থাকে। কিন্তু শীতকালে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে যখন বাতাস না আসে, তখন বায়ুর গতিবেগটা অনেক কমে যায়। এটা উত্তর দিক থেকে ঘণ্টায় ৩-৪ কিলোমিটার বেগে আসে।
ড. কামরুজ্জমান বলেন, এই বায়ু প্রবাহ যেকোনো জায়গার ধোয়া, ধুলা কিংবা দূষণকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে না। কারণ, বাতাসের গতিবেগ কম থাকে। অন্যান্য সময় এই ধোয়া ও ধুলা দক্ষিণ থেকে বাতাসে উত্তর দিকে নিয়ে যেত। এটা হিমালয়ে জমা হতো। শীতকালে হিমালয় থেকে উত্তর-পূর্ব দিক হয়ে শীতকালীন ও অন্যান্য বায়ু প্রবাহিত হয়। এটার গতিবেগ কম থাকে। কিন্তু এটা ব্ল্যাক কার্বন ও অন্যান্য দূষিত বায়ু নিয়ে আসে। তার মানে বায়ুর গতিবেগ কম থাকে আবার বায়ু আসতেই ধুলাবালি নিয়ে আসে। আবার তাপমাত্র যখন কমে যায়, তখন এই তাপে জলীয়বাষ্প থাকে। এই জলীয়বাষ্প ধুলা বালুতে ভিজিয়ে ফেলে। ফলে এগুলো উড়ে চলে যেতে পারে না। নিচের স্তরে চলে যায়।
এই পরিবেশবিদ আরও বলছেন, আমাদের ইটের ভাটা, আমাদের মেগা প্রজেক্টেও ধুলাবালি বাড়ার কারণ। এছাড়া শীতে ভবন নির্মাণ বেড়ে যায়। ইট- বালুর ব্যবহারও বেড়ে যায়। প্রায় ৫০টির মতো সিমেন্ট কারখানা ও প্রায় ১ হাজার ৩শ’র মতো ইটভাটা ঢাকার চারপাশে আছে। এ সময় এদের উৎপাদন ও বেড়ে যায়। আবার এই সময়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িও বেড়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ড. আদিলুর রহমান বলেন, শীতের সময় খোঁড়াখুঁড়িতে দূষণের মাত্রা একটু বেশি হয়। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় ভবন নির্মাণের পরিমাণ একটু বেশি। এখানে কন্সট্রাকশন ম্যানেজমেন্টে আমরা অনেক উদাসীনতা দেখি। মনিটরিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের গাইডলাইন দেয়া আছে। কিন্তু তারা সেটা মানে না। কোম্পানিগুলো কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না।
তিনি আরও বলেন, কাজগুলো বুঝে নেয়ার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের গাফলতি আছে। প্রজেক্টগুলো বুঝে নেয়াতে যারা সুপারভিশনে আছে তাদের মনিটরিংয়ে অনেক দুর্বল। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রকল্পগুলো যারা করছে তারাও গাফলতি করছে। সেসব জায়গাতে নজর বাড়ালে ধুলার পরিমাণ কিছুটাও হলেও কমবে।
করোনাভাইরাসের কারণে বাসগুলো ৬ মাস রাস্তা-ঘাটে চলাচল করতে না পারায় সেগুলোর ইঞ্জিন, ফিটনেস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে এখন যখন বাসগুলো রাস্তায় বের হচ্ছে সেগুলোও বায়ু দূষণ করছে বলে মনে করেন ড. আহমদ কামরুজ্জমান।
তিনি বলেন, করোনার কারণে যান চলাচল বন্ধ ছিল। দীর্ঘ একটা সময় বাসগুলো রাস্তায় চলেনি। ৬ থেকে ৭ বসে থেকে কোনো প্রকার রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সার্ভিসিং ছাড়াই বাসগুলো নেমেছে রাস্তায়। এর ফলে এগুলোর ইঞ্জিন কিন্তু ড্যামেজ হয়েছে। এগুলো কেউ খেয়াল করছে না। সব গাড়ি থেকে প্রচুর দূষণ হচ্ছে।
এই পরিবেশবিদ বলেন, শীতের সময় ভারতের মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ছাড়াও পাকিস্তানের কিছু জায়গা থেকৈ দূষিত বায়ু এদেশে আসে। এটাকে আমরা আন্তঃসীমান্ত বায়ু দূষণ বলে থাকি। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভারতে কিছু প্রদেশে তারা প্রচুর ঘাসসহ অন্যান্য শস্য পোড়ায়। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে এই শস্যগুলো পোড়ানো শুরু করে। তখন দেখা যায়, নভেম্বরের ২৫-২৬ তারিখের দিকে দিল্লিতে বায়ুদূষণ দেখা দেয়। দিল্লি থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৪০০ কিলোমিটার, যা ঢাকা আসতে ৭ থেকে ৮ দিন সময় লাগে। অর্থাৎ, দিল্লিতে নভেম্ববর মাসের শেষের দিকে বায়ুদূষণ হয়। ফলে ঢাকায় ডিসেম্বরের ৫ থেকে ৬ তারিখে বায়ুদূষণ বেড়ে যায়।
নদী বন্দর / পিকে