মুন্সীগঞ্জ জেলায় প্রধান উৎপাদনকারী ফসল আলু। আলু উৎপাদনে দেশের শীর্ষস্থানে রয়েছে এ জেলাটি। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আলু উত্তোলন শুরু হয়েছে। তবে আলুর ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এ বছর বিক্রি থেকে মজুদে বেশি আগ্রহী প্রান্তিক কৃষকরা।
বৃৃৃৃহস্পতিবার সরেজমিনে সদর উপজেলার দেওয়ান আইস এন্ড কোল্ডস্টোরেজ, মুক্তারপুর মাল্টিপারপাস কোল্ডস্টোরেজ ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নূর কোল্ডস্টোরেজ, শরীফ কোল্ডস্টোরেজ, সোবাহান কোল্ডস্টোরেজসহ আটটি হিমাগার ঘুরে দেখা যায়, আলু নিয়ে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন শ্রমিক ও কৃষকরা। আলু বস্তা ভর্তি ট্রাক, ছোট গাড়ি ও ট্রলার থেকে নামিয়ে সারি সারি করে আলুর বস্তা হিমাগারে রাখছেন।
এ বছর আলুর পাইকারি ব্যবসায়ীর তুলনায় প্রান্তিক কৃষকরা হিমাগারে বেশি আলু মজুদ করছেন। বিভিন্ন স্থানের কৃষকরা তাদের আলু নিয়ে হিমারগারগুলোতে ভিড় জমিয়েছেন। কেউ কেউ আগেই আলু সংরক্ষণ করার জন্য হিমাগারের জায়গা বুকিং দিয়েছেন। কেউ বা ভাড়ায় আলু রাখার জন্য নতুন করে চুক্তিপত্র করছেন।
তবে আলু সংরক্ষণের পরও কৃষকদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। কেননা এবার প্রতি কেজিতে আলুর উৎপাদন খরচ ১৩ থেকে ১৪ টাকা আর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১ থেকে ১২ টাকায়। হিমাগারে সংরক্ষণ ও পরিবহন খরচ মিলিয়ে ১৭ থেকে ১৯ টাকা লাগছে। এতে করে দাম নিয়ে লোকসানের শঙ্কায় দেখা দিয়েছে। আলুর দাম সরকারকে নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি কৃষকদের।
সদর উপজেলার বকুলতলা এলাকার কৃষক মইনউদ্দিন সরকার জানান, তিনি এ বছর ১২ কানি (৪৬৮ শতাংশ) জমিতে আলু রোপণ করেন। গত বছরের তুলনায় এ বছর তার আলু উৎপাদন কম হয়েছে । অন্যদিকে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হয়। তিনি বলেন, গতবছর প্রতি দুই শতাংশ জমিতে ৮ মণ আলু উৎপাদন হলেও এ বছর সাড়ে ৬ মণ হয়েছে। এ ছাড়া মণ প্রতি আলু উৎপাদন খরচ পড়েছে ৫ শ’ টাকার বেশি। কিন্তু বর্তমান বাজারমূল্য ৪৬০ টাকা। তাই দুই হাজার বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করেছি। যদি দাম বাড়ে তবেই আলু বিক্রি করবো।
এছাড়া হিমাগারগুলোতে জায়গা না থাকায় এখনো জমিতে আরো ১২ শ’ বস্তা আলু পড়ে আছে। সুযোগ পেলে তাও মজুদ করার ইচ্ছে আছে।
জাজিরা এলাকার প্রান্তিক কৃষক আলী আসলাম গাজী বলেন, গতবছর আলু চাষ করে শেষ সময় লাভের মুখ দেখেছিলাম। সে আসায় এবারও তিন কানি (১১৭ শতাংশ) জমিতে আলু চাষ করি। কানি প্রতি আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু শুরুতে আলুর দাম পড়ে যাওয়ায় কিছুটা হতাশ হয়েছি। শেষ সময় যদি আলুর দাম পাই, সেই আশায় হিমাগারে আলু মজুদ করেছি। মণ প্রতি উৎপাদন খরচের পাশাপাশি হিমাগার ও পরিবহন ভাড়াসহ এখন আলুর মূল্য প্রায় ৭ শ’ টাকা লাগছে।
আলুর ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, উত্তরবঙ্গ থেকে সাড়ে ৭ শ’ থেকে ৮ শ’ টাকা প্রতি বস্তা আলু ক্রয় করেছি। এখন বাজার মূল্য অনেক কমে গেছে। যদি হিমাগারগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যায় তাহলে আলুর মূল্য আরো কমে যাবে। তখন আলু পঁচে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই কিছুটা লস দিয়ে হলেও বিক্রি করে ফেলবেন।
দেওয়ান আইস এন্ড কোল্ডস্টোরেজের মালিক আরশ দেওয়ান বলেন, আমাদের হিমাগারে ৫ লাখ বস্তা আলু সংরক্ষণ করা যায়। ইতিমধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় নতুন বুকিং নেওয়া হচ্ছে না। মুন্সীগঞ্জের স্থানীয় আলুর পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের দেড় লাখ আলুর বস্তা এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সূত্রে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জে ডায়মন্ড, কার্ডিনাল ও এস্টারিকস জাতসহ দশ প্রজাতির আলুর চাষ হয়। গতবছর ৩৭ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আলু উৎপাদন হয়েছিলো ১৩ লাখ ২ হাজার ২৭ মেট্রিক টন।
এবার ৩৭ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার ২৬৫ হেক্টর জমিতে বেশি আলু আবাদ হয়। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১২ লাখ ৭৪ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। জেলায় আলু সংরক্ষণে ৭৪টি হিমাগার রয়েছে। তবে এসব হিমাগারে ধারণ ক্ষমতা মাত্র পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। এ কারণে আলু বিক্রি না করলে পচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে বড় লোকসানের মুখে পড়তে পারেন এ অঞ্চলের আলু চাষিরা।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, গতবছর আলুর দাম বেশি ছিল, এ বছর দাম কিছুটা কম। উৎপাদনকৃত আলুগুলোকে যদি সরকার সংরক্ষণ করে বা বিদেশে রপ্তানি করা যায় তাহলে কৃষক লাভবান হবে। এ ছাড়া যদি আলুভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে বহুমাত্রিক ব্যবহার বৃদ্ধি করা যায় তাহলে আলুর দাম কখনো কমবে না।
কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, এ বছর আলুর উৎপাদন ভালো হয়েছে আশা করা যায় জেলায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হবে। অন্যদিকে আলুর উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ৯ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১১ টাকা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ১১ টাকার নিচে যদি বিক্রি করে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক। যদি ১৫ টাকার উপরে ২০ টাকার মধ্যে যদি দাম থাকে তাহলে কারো পক্ষে সমস্যা হবে না।
নদী বন্দর / জিকে