সুন্দরবনে শুরু হচ্ছে মধু আহরণ মৌসুম। ১ এপ্রিল থেকে পাস-পারমিট (অনুমতিপত্র) দেওয়া শুরু করবে বন অফিসগুলো। এজন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগেরহাটের শরণখোলার প্রায় পাঁচ হাজার মৌয়াল। এসব মৌয়ালদের বেশিরভাগই মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে বনে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পাসের অপেক্ষায় বসে আছেন বন অফিসের ঘাটে। আবার এখনও নৌকা প্রস্তুতির কাজ চলছে অনেকের।
আজ মঙ্গলবার (৩০ মার্চ) সুন্দরবনসংগ্ন কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ অফিসের তথ্য মতে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে (গত মৌসুমে) শরণখোলা রেঞ্জের বন থেকে ৭১১ দশমিক ৫০ কুইন্টাল মধু এবং ২১৩ দশমিক ৪৫ কুইন্টাল মোম আহরণ করা হয়। সেখানে এবছর মৌসুমের তিন মাসে ৮০০ কুইন্টাল মধু এবং ২৫০ কুইন্টাল মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্র নির্ধাণ করেছে বনবিভাগ। সেই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ১ এপ্রিল শরণখোলা স্টেশন থেকে পাস-পারমিট দেওয়া শুরু হবে।
মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে খলিশা ফুলের মধু আসে। এর পর আসে গারণ ফুলের। এবং সর্বশেষ আসে কেওড়া ও ছইলা ফুলের মধু। এই তিন প্রজাতির মধুর মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে খলিশার মধু। কিন্তু এবছর এ অঞ্চলে কোনো বৃষ্টি হয়নি। আর বৃষ্টি না হলে ফুলে মধু জমে না। ফুল শুকিয়ে ঝরে যায়। তাই এবছর মধু কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন মৌয়ালরা।
নৌকা প্রস্তুকালে কথা হয় খুড়িয়াখালী এলাকার নৌকার মালিক মৌয়াল মো. ইউনুচ হাওলাদারের (৬৫) সঙ্গে। তিনি জানান, তার নৌকাটি প্রস্তু করতে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হবে। কাজ প্রায় শেষের পথে। দুই-তিন তারিখ তারা পাস নিয়ে বনে যাবেন। তার নৌকায় ১২ জন ভাগী রয়েছে।
মৌয়াল ইউনুচ হাওলাদার আরো জানান, গত বছর একেকজন ভাগী দুই মন করে মধু পেয়েছেন ভাগে। ২৫ হাজার টাকা মন দরে তা বিক্রি করেছেন। মৌসুমের তিন মাসে মধু আহরণ করতে গিয়ে একেকজন মৌয়ালের খরচ হয় ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। এবার বৃষ্টি নেই। তাই মধু কেমন হবে তা বলা যাচ্ছে না।
সকল প্রস্তুতি নিয়ে শরণখোলা রেঞ্জ অফিসের অপর পারে ঘাটে নৌকা নিয়ে অবস্থান করছেন মৌয়াল সোবাহান হাওলাদার (৬০)। তিনি জানান, তার নৌকায় ১০ জন মৌয়াল (ভাগী) রয়েছেন। মৌসুমের প্রথম দিনেই (১ এপ্রিল) তারা পাস নিয়ে বনে যাবেন। তারা গহীন সুন্দরবনের জাইল্যার ট্যাক এলাকা থেকে মধু সংগ্রহ করবেন।
শরণখোলার খুড়িয়াখালী গ্রামের সৌখিন মধু ব্যবসায়ী মো. রাসেল আহমেদ জানান, তিনি এবছর তিনটি নৌকায় দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তার আরো বেশি বিনিয়োগের ইচ্ছা ছিল এবার। কিন্তু বৃষ্টির গতিবিধি খারাপ দেখে তিনি বেশি বিনিয়োগে সাহস করেননি। কারণ, এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় বনে ফুলের সমারোহ বেশি থাকলেও তার ঝরে যাচ্ছে। আর ফুল টিকে না থাকলে মধুও কম হবে। যা বিনিয়োগ করেছেন তাও উঠবে কিনা সেই আশঙ্কায় রয়েছেন তিনি।
পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, সুন্দরবনে মৌসুমে মধু কম-বেশি হওয়া অনেকটা বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। এবার একেবারেই বৃষ্টি নেই। তাই লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও শঙ্কিত বনবিভাগ। সামনে বৃষ্টিপাত হলে হয়তো টার্গেট পূরণ হবে।
এসিএফ জয়নাল আবেদীন জানান, সংশ্লিষ্ট বন অফিস থেকে ১৪ দিনের পাস গ্রহণ করে বনে প্রবেশ করবে মৌয়ালরা। এর মধ্যে অনুর্ধ্ব ২০০ মণ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈধ বি এল সি ধারী নৌকার মালিক হতে হবে। সংরক্ষিত অভয়ারণ্য এলাকা থেকে মধু আহরণ করা যাবে না এবং কোনো মৌয়াল নিষিদ্ধ বনাঞ্চলে প্রবেশ করলে তাৎক্ষণিক তার পারমিট বাতিল করা হবে।
এ ছাড়া পাসধারী মৌয়ালগণ মধু আহরণের জন্য মৌমাছি তাড়াতে অগ্নিকুণ্ড, মশাল বা অনুরূপ কোনো দাহ্য পদার্থ এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে পারবে না। এগুলোসহ ৯টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মৌয়ালদের। এই নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে বন আইনে শাস্তির বিধারনও রয়েছে।
নদী বন্দর / এমকে