বিলের এক কোণে অর্ধশত বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ। খেতজুড়ে পাতার মাঝে উঁকি দিচ্ছে কচি ধানের শীষ। সবকিছু ঠিক থাকলে দু’মাস বাদেই কৃষকের গোলায় ধান ওঠার কথা। কিন্তু সেচের অভাবে ধানের কচি পাতা লালচে হয়ে এসেছে। কেননা বিলের খাস জলমহাল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গ্রামবাসীর বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষরা আবাদি জমিসহ একটি গ্রামকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছে।
তিন মাস আগে থেকেই গ্রামটির ৮০টি পরিবার ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামে।
আটাই ও ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের এক কোণে পাঙ্গিয়ার দীঘি। এটি ৫২ একর ৭২ শতক আয়তনের একটি সরকারি জলমহাল (দুটি মৎস্য অভয়াশ্রমসহ)। ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের ক্ষিদ্রি আটাই মৎসজীবী সমবায় সমিতি প্রায় এক বছর আগে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকায় তিন বছরের জন্য জলমহালটি সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয়। কচুরিপানা পরিষ্কার, মাছের পোনা ছাড়া, খাদ্য সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা বাবদ ওই সমিতি এ পর্যন্ত ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেছে।
কিন্তু ইজারা নিতে ব্যার্থ হয়ে আটাই গ্রামের লোকজন গত ডিসেম্বর মাসে জোর করে দীঘিটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইজারা গ্রহিতাদের সেখানে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। উভয় গ্রামবাসীর মধ্যে শুরু হয় বিরোধ। পরে তা সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নেয়।
ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের ৮০টি পরিবারে ২৬০ জনের বসবাস। অন্যদিকে আটাই গ্রামের ৪০০ পরিবারে ১ হাজার ২০০ লোকের বসবাস। পাঙ্গিয়ার দীঘির নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে জনবলে বলিয়ান আটাই গ্রামবাসী গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর মসজিদের মাইকে ও হ্যান্ডমাইকে ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে। পাশাপাশি বিলে ওই গ্রামবাসীর যেসব জমি আছে সেখানে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। বিলে নামলেই তাদেরকে তাড়া করা হয়।
এমনকি নিজ গ্রামেও তারা ঘর থেকে বের হতে পারে না। প্রতিপক্ষরা লাঠি নিয়ে একাধিকবার গ্রামে ঢুকে ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামবাসীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। জীবন বাঁচাতে তারা এখন ঘরবন্দি।
ক্ষিদ্রি আটাই মৎসজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ইজারা নেয়া জলাশয়ে গত তিন মাসে অন্তত ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিপক্ষরা পাঙ্গিয়ার দীঘি দখল করে নেয়ায় ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি অন্তত ১০ লাখ টাকার মাছ চুরি হয়েছে। এছাড়া প্রতিপক্ষরা আমাদের ২৫ বিঘা জমির সাড়ে ৭০০ মণ রসুন ও ১০ বিঘা জমির ২০০ মণ গম কেটে নিয়ে গেছে। প্রাণনাশের হুমকির মুখে আমি, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সর্দার, কোষাধ্যক্ষ বেলাল সর্দার গ্রাম ছেড়ে আত্মগোপনে আছি।
তিনি বলেন, হামলার ভয়ে গ্রামের লোকজন বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। চাষাবাদ করতে না পারায় অনেক জমি অনাবাদি রয়েছে। প্রায় ৫০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছিল। এখন শীষ বের হওয়ার সময়। অথচ প্রতিপক্ষদের বাধার মুখে সেচ দিতে পারছি না। সেচের অভাবে সবুজ ধান লালচে বর্ণ ধারণ করতে শুরু করছে।
গ্রামের কৃষক রহমত আলীর বলেন, গত ২৪ ডিসেম্বর আমার বাড়িতে বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। পরের দিন বিকেলে আটাই গ্রামের মসজিদের মাইকে ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে প্রতিপক্ষরা। আটাই গ্রামের শত শত লোক লাঠি, ফলা নিয়ে ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামে আসে। তারা হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা করে এই গ্রামে বিয়েসহ কোনো ধরনের অনুষ্ঠান করা যাবে না। বাড়ি থেকে কেউ বের হতে পারবে না। লকডাউন ভঙ্গ করলে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, সশস্ত্র লোকজন আমার বাড়ির ভেতরে ঢুকে বিয়ের ডেকোরেশনের জিনিসপত্র ও একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে চলে যায়। এ ঘটনায় আমি নিজে বাদী হয়ে বড়াইগ্রাম থানায় মামলা করি। এর দুই দিন পর প্রতিপক্ষরা মাঠে নেমে আমাদের ৮টি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত সেচযন্ত্র ভাঙচুর করে। এর ১৫ দিন পর আবারও মাঠের ৬টি সেচযন্ত্র ভাঙচুর করা হয়। এই ঘটনার পর প্রতিপক্ষরা মাঠে ও গ্রামের চারিদিকে নজরদারি শুরু করে। আমাদের কেউ মাঠে গেলে ধরে মারপিট করা হয়।
গত ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় মাঠে নামার কারণে প্রতিপক্ষরা নাহিদ (২০) ও তার ভাই শাওনকে (১৫) বেধড়ক মারপিট করে। সর্বশেষ ২৪ মার্চ সকালে গ্রামের কৃষক ইব্রাহিম হোসেন গরুর ঘাস কাটতে মাঠে গেলে প্রতিপক্ষরা তাকে অপহরণ করে এবং গাছের সাথে বেঁধে মারপিট করে।
রহমত আলী আরও বলেন, আমরা সরকারের কাছ থেকে বৈধভাবে দীঘিটি ইজারা নিয়েছি। অথচ আটাইয়ের লোকজন দীঘিটির দখল নিয়ে মাছ ধরছে। স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আমাদের ৩ মাস ধরে লকডাউনে রেখেছে। বাড়ির বাইরে বের হতে পারি না। বের হলে মার খাওয়ার ভয় থাকে। মাঠে সেচের অভাবে ধান নষ্ট হচ্ছে। অনেক জমি খালি পড়ি আছে। এভাবে চললে আর কদিন পর অনাহারে থাকতে হবে।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, পুলিশের কাছে প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে এসব নির্যাতনের বিচার চেয়ে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। তাই জীবন রক্ষার জন্য চাষাবাদ বন্ধ করে ঘরবন্দি হয়ে আছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও মৎস্য কর্মকর্তাদের কাছে গিয়েও তারা সমাধান পাননি।
তবে অভিযোগ প্রসঙ্গে আটাই গ্রামের মাতব্বর খলিল সোনার বলেন, আমরা ইজারা ছাড়াই দীঘিটি ভোগ-দখল করেছি। আমাদের না জানিয়ে ক্ষিদ্রি আটাইয়ের কিছু লোক দীঘি ইজারা নিয়ে ভোগ করতে চায়। তাই অন্যায় হলেও দীঘিটি আমরা দখল করে রেখেছি। যতদিন ক্ষিদ্রি গ্রামের লোকজন আপোস না করবে ততদিন তাদের লকডাউন করে রাখা হবে।
এমনকি পাল্টা অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের আনোয়ার হোসেন মৎসজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাকে অন্যায়ভাবে বের করে দিয়ে ক্ষিদ্র আটাই গ্রামের লোকজন অমৎস্যজীবীদের নিয়ে সমিতির ভুয়া কমিটি করে ইজারা নিয়েছে।
এ বিষয়ে বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ক্ষিদ্রি আটাই গ্রামের লোকজন বিধি বিধান মেনে ইজারা নিয়েছেন। তাই আমরা জলাশয়টি ভোগদখলে ইজারা গ্রহিতাকে আইনানুগভাবে যতটুকু সহযোগিতা করা দরকার তা করব। তবে জলশয়কে কেন্দ্র করে কেউ ফৌজদারি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করলে তার বিরুদ্ধে ইজারা গ্রহিতা পুলিশের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারেন। অবরুদ্ধ করে রাখার কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বড়াইগ্রাম থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কোনো পরিবার অবরুদ্ধ আছে, এমন কোনো অভিযোগ নেই পুলিশের কাছে। কেউ অভিযোগ দিলে তদন্ত করা হবে।
নদী বন্দর / পিকে