বরগুনায় সরকারি খাল দখল করে মাছের ঘের তৈরি করেছেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী। সেই ঘেরের লবণাক্ত পানিতে ডুবে ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে গেঠে এই জেলার তালতলীর প্রায় দেড়শ একর জমির ইরি ধান। অভিযুক্ত নাসির মুন্সি খালে ঘের করার কথা স্বীকার করলেও বাঁধ কেটে লবণাক্ত পানি ঘেরে নেওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন।
বরগুনার তালতলী উপজেলার শারিকখালী এলাকার কৃষক আবু সালেহ। প্রখর রোদে বসে তাকিয়ে দেখছেন সোনালি ফসলের মৃত্যুদৃশ্য। একদিকে সূর্যের প্রচণ্ড তাপ, অন্যদিকে ক্ষেতভরা লবণাক্ত পানি। পুরো স্বপ্নই মরে যাচ্ছে তার। ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে দুই একর জমিতে হাইব্রিড ইরি জাতের ধানের চাষ করেছিলেন তিনি। গত ১০ এপ্রিল গভীর রাতে উপজেলার শারিকখালী ইউনিয়নের সাত খালের বাঁধ কেটে মাছের ঘেরে লবণাক্ত পানি নেন স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী নাসির মুন্সি। সেই পানিতেই তলিয়ে যায় আবু সালেহের ধানক্ষেত।
আবু সালেহ বলেন, ‘মুই এবার ধার-দেনা কইরা দুই একর জমিতে ইরি আবাদ করেছিলাম। নাসির মুন্সি রাইতে খালের বান্দা কাইঠা দেওয়ার লগে লগে লবণাক্ত পানি ঢুইক্কা মোর দুই একর জমরি ধান তলাইয়া গেছে। মোগো ধান তো হইবোনা। এহন চিন্তায় আছি কিভাবে লোনের টাহা দিমু?’
এমন স্বপ্নডুবির গল্প এই এলাকার শত শত কৃষকের। কৃষকরা বলছেন, সরকারি খাল দখল করে মাছের ঘের করেছেন নাসির মুন্সি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক শামীম মৃধা,শহীদ মৃধা, জাফর চৌকিদার বলেন, ‘নাসির মুন্সির বিরুদ্ধে কথা বললইে হুমকি দেন, মারধর করে। তার ভয়ে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করে না। শত শত কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ কৃষিকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।’
একই খালের পানির ওপর নির্ভরশীল এ এলাকার হাজারও কৃষক। তাদের মধ্যে শাহ-আলম একজন। তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম না নাসির মুন্সি বাঁধ কেটে লবণাক্ত পানি ঢুকিয়েছেন খালে। ফসলের মাঠে পানি দিতেই কয়েক দিনের মধ্যে মরে গেছে আমার ফসলের গাছ। এরপর বন্ধ করে দেই পানি দেওয়া। এখন যেসব ক্ষেতে পানি দিতে পারিনি, সেসব ক্ষেতের ধানেও পুষ্টি পাচ্ছে না। মিষ্টি পানির অভাবে গাছগুলো মরে যাচ্ছে। আবার লবণাক্ত পানি দিলেও গাছ মরে যাচ্ছে। এখন আমাদের বাঁচার কোনো উপায় নেই।’
শারিকখালী ইউনিয়নের সাত বাঁধের খাল, বাদুরগাছিয়া এলাকার একাধিক বলেন, ‘প্রতি বছর এই একই কাজ করেন নাসির মুন্সি। এবারও তিনি বাঁধ কেটে লবণাক্ত পানি ঢুকিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে কাঁচা ধান কেটে ফেলেছি। নয়তো ক্ষেতেই সব চিটা হয়ে পড়ে থাকবে। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিন্টু একাধিকবার ঘটনাস্থলে এসেছেন, নাসির মুন্সিকে নিষেধ করেছেন। তবু তিনি কথা শোনেননি। তিন ফসলি জমি এখন দু’ফসলি জমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। এমন লবণাক্ত পানি এলে এই জমিতে চাষাবাদ করারই সুযোগ থাকবে না আর।’
তালতলী কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাসুম বিল্লাহ পরিদর্শন করেন ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেতগুলো। এসময় তিনি বলেন, ‘একজন নাসির মুন্সির এমন কাজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন হাজারও কৃষক। এমনিতেই প্রচণ্ড তাপদাহ, তারপর আবার বৃষ্টিও হয়নি। তারমধ্যে যদি লবণাক্ত পানি এভাবে ক্ষেতে ঢুকতে থাকে, তাহলে কৃষকদের পথে বসতে হবে। নাসির মুন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতনদের জানিয়েছি।’
এ বিষয়ে অভিযুক্ত নাসির মুন্সি বলনে, ‘খালটি এমনিতেই পড়ে আছে। তাই অল্প জায়গায় মাছ চাষ করেছি। কিন্তু বাঁধ কাটা ও কৃষকদের ক্ষতির ব্যাপারে কিছুই জানি না।’
তালতলী উপজলো কৃষি কর্মকর্তা আরিফ হোসেন বলেন, ‘কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। নাসির মুন্সি কৃষকদের ক্ষতিপূরণ না দিলে তার বিরুদ্ধে কৃষকরা মামলা করবেন। এক্ষেত্রে কৃষি অফিস কৃষকদের সহায়তা করবে।’
বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরচিালক এস. এমবদরুল আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানিয়েছেন। কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা তাদের কৃষি প্রণোদনার ব্যবস্থা করবো।’
জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কৃষি কর্মকর্তা ধানের ক্ষতির ব্যাপারে আমাকে জানিয়েছেন। অবশ্যই খাল থেকে মাছের ঘের গুঁড়িয়ে দেবো। হাজার হাজার কৃষক যেন খালটি ব্যবহার করে দেশের শষ্য ভাণ্ডারে চাহিদার জোগান দিতে পারে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-সূত্রে জানা গেছে, জেলায় কৃষি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে তিন ফসলি জমি ৫১ হাজার ৩৮০ হেক্টর।
নদী বন্দর / পিকে