রমজানের আগে প্রাণসহ দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের উৎপাদিত দুধের দাম দু’ দফা বাড়িয়েছে। দুধের ভালো দাম পাওয়ায় খুশি বৃহত্তর পাবনার অর্ধলাখ খামারি। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন পর্যাপ্ত দুধই জোগান দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
তবে দুধের দামে খুশি হলেও গো-খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় আশানুরূপ লাভবান হতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন খামারিরা। তারা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় সরকারিভাবে গো-খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি চালু করা ও এর মাধ্যমে সাবসিডি প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। গো-খাদ্যের দাম না কমলে অনেকের পক্ষে গাভি পালন সম্ভব হবে না বলে তারা মনে করছেন।
দুধের দেশ নিউজিল্যান্ড খ্যাত বৃহত্তর পাবনার কয়েকটি উপজেলার (সাঁথিয়া, বেড়া, শাহজাদপুর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া) বেশিরভাগ গ্রামের বসতবাড়ির অঙিনায় ও বাথান এলাকায় গবাদিপশু পালন করা হয়। লক্ষাধিক উন্নতজাতের গাভি পালনের আয়ে এলাকাবাসির আর্থিক অবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। উন্নতজাতের গাভি পালন করে এসব এলাকার হাজার হাজার কৃষক অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। এমন অনেক খামারি আছেন যাদের কৃষিকাজ করে এক সময়ে দু’বেলা পেটের ভাতই জুটত না, সেই তারাই এখন গাভি পালন করে প্রতিদিন এক থেকে দুই মণ দুধ বিক্রি করে ২-৪ হাজার টাকা আয় করছেন। আয়ের অর্থ দিয়ে তারা প্রতি বছর জমিজমা কেনা থেকে শুরু করে ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
সাঁথিয়া উপজেলার রতনপুর গ্রামের ফজলু খান নামের এক গো-খামারি জানান, দু’বছর আগে তিনি ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ‘ফ্রিজিয়ান-১০০’ জাতের একটি গাভি কিনে লালন-পালন শুরু করেন। ওই গাভিটির বর্তমান মূল্য প্রায় দুই লাখ টাকা। গাভিটি এক বছর আগে একটি উন্নতজাতের বাছুর জন্ম দেয়। বাছুরটির বর্তমান দাম প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
গাভিটি সম্প্রতি আরও একটি উন্নতজাতের বকন বাছুর প্রসব করেছে যার বর্তমান দাম প্রায় ৩০ হাজার টাকা। মাত্র দুই বছরের মধ্যে গাভিটিসহ দুটি বাছুরের বর্তমান দাম দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। প্রতিদিন ২২ লিটার করে দুধ দিচ্ছে গাভিটি। গড়ে ৪৫-৫০ টাকা লিটার দরে এই দুধ বিক্রি করে প্রতিদিন হাজার টাকা আয় হচ্ছে। এ থেকে গাভিটির প্রতিদিনের খাওয়া খরচ ৩০০ টাকা বাদ দিলে প্রায় ৭শ টাকা আয় থাকছে। এ হিসেবে প্রতি মাসে তার লাভ হচ্ছে ২১ হাজার টাকা। এ আয় থেকে তিনি সংসার খরচ চালিয়েও বাড়তি সঞ্চয় করে প্রতিবছর জমি কিনছেন।
রতন শেখের মতো হাজার হাজার গো-খামারি বৃহত্তর পাবনা জেলায় উন্নতজাতের গাভি পালন করছেন। তাদের কেউ বসতবাড়িতে আবার কেউ কেউ বাথানে গাভি পালন করেন। এসব চাষিদের একটি থেকে শুরু করে শতাধিক গাভি রয়েছে।
প্রাণ ডেইরি মিল্কের শাহজাদপুরের এজিএম ইফতেখারুল ইসলাম সোমবার (১৭ মে) জানান, এবার রমজানের আগে দু’দফায় দুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে চাষিরা ফ্যাট ভেদে ৪৩-৫০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে পারছেন। ক্ষেত্রবিশেষ ফ্যাটের মাত্রা বেশি হলে চাষিরা ৫৫ টাকা লিটার পর্যন্ত দাম পাচ্ছেন। তিনি জানান, বৃহত্তর পাবনায় শুধু প্রাণেরই প্রায় ৩০টি দুগ্ধ ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে জানান, দুধ খামারিদের এখন সুদিন যাচ্ছে। তাদের দুর্দিন নেই। তার জানামতে সব কোম্পানিই দুধের দাম বেশি দিচ্ছে খামারিদের।
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার অন্যতম দুধ উৎপাদনকারী অঞ্চল ডেমরার খামারি ও দুধ ব্যবসায়ী শামীম হোসেন জানান, চাষিদের সেই দুর্দিন এখন নেই। তারা এক সময় উপযুক্ত দাম না পেয়ে রাগে, ক্ষোভে রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ করেছেন। এখন চাষি ও খামারিরা দুধের দামে খুশি। তবে গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছেন। তাদের লাভের বিরাট অংশ খরচ হয়ে যাচ্ছে। করোনা সমস্যাজনিত লকডাউনের কারণে গো-খাদ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে।
তিনি জানান, গমর ভুসি বস্তাপ্রতি ১১শ’ টাকার জায়গায় হয়েছে ১২শ’ টাকা, কাউফিড বস্তাপ্রতি ৯শ’ টাকার জায়গায় বেড়ে হয়েছে ১০৫০ টাকা। ডালের ভুসি বস্তা (৩৫ কেজি) প্রতি কিনতে হচ্ছে ১২শ’ টাকা, অ্যাংকর ডালের ভুসি ৮ শ’ টাকা টাকা দরে কিনতে হচ্ছে।
‘ধানের খড়ের দামও বেশি। ৬শ’ টাকা মণ দরে খড় কিনতে হচ্ছে। খড়ের মণ নাকি ৩০ কেজিতে। প্রতি শতাংশ জমির জাম্বু ঘাস কিনতে হচ্ছে ৩০০ টাকা দরে, প্রতি শতাংশ জমির নেপিয়ার ঘাস ৪০০ শ’ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। গো-খাদ্যের দাম কমানো না হলে বা খামারিদের ভর্তুকি মূল্যে গো-খাদ্য না দিলে খামার ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে’
ফরিদপুর উপজেলার দুগ্ধ সমবায় সমিতির ম্যানেজার হযরত আলী জানান, তারা চিলিং সেন্টারে ফ্যাটভেদে ৪২-৪৪ টাকা কেজি দরে দুধ বিক্রি করতে পাচ্ছেন।
তিনি জানান, এরকম দাম থাকলে তারাও লাভবান, খামারিরাও লাভবান। কিন্তু খামারিদের লাভটা শেষ হয়ে যাচ্ছে গো-খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে। এ ব্যাপারে তার ভাষ্য, ‘এক কেজি খৈলের দাম ৪০-৪২ টাকা। তাহলে কৃষক কিভাবে দুধেল গাভিকে খৈল খাওয়াবেন?’
চিলিং সেন্টারগুলোতে দুধের এখন ভালো কদর বলে জানান হযরত আলী। তিনি প্রতিদিন অন্তত ৩শ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ লিটার দুধ সরবরাহ করেন। তার এলাকায় তারমতো দু-তিনশ দুধের ব্যাপারি রয়েছেন। যারা এলাকায় ‘ঘোষ’ বলে পরিচিত।
সাঁথিয়ার পোরাট দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির ফজলুর রহমান জানান, গাভী লালন-পালন করা অনেক কষ্টের ব্যাপার। তার খাবার প্রস্তুত করে খাওয়ানো, পরিচর্যা, দুধ দোহন করা, গোয়াল পরিষ্কার, গাভির গোসল সবই সময় ও শ্রমের ব্যাপার। এসব নেপথ্য শ্রম ধরলে আর খাবারের দাম বাদ দিলে লাভের পরিমাণ কমে যায়।
বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়নের (মিল্কভিটা) সাবেক সভাপতি হাসিব খাঁন তরুণ জানান, বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ লিটারের বেশি দুধ উৎপাদন হয়। দুগ্ধ উৎপাদনকারীরা পাবনার ভাঙ্গুড়া ক্রয়কেন্দ্র, সিরাজগঞ্জের লাহিড়ী মোহনপুর ও বাঘাবাড়ি মিল্কভিটায় প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ লিটার দুধ সরবরাহ করেন। এ অঞ্চলে প্রায় এক হাজার দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমিতির মাধ্যমে এ দুধ সরবরাহ হয়। সমিতিভুক্ত মোট সদস্যের সংখ্যা ৫০ হাজার। সমিতির বাইরেও কয়েক হাজার খামারি দুধ সরবরাহ করে থাকেন বলে তিনি জানান। এছাড়া ৭৫ থেকে ৮০ হাজার লিটার দুধ প্রাণ, আফতাব, আকিজ, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান এবং ঘোষরা ২৮ থেকে ২৯ হাজার লিটার দুধ কিনে থাকে। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দুধ কিনে প্রক্রিয়াজাত করে রাজধানীতে পাঠাতে অনেক চিলিং সেন্টার স্থাপন করেছে। বেশিরভাগ স্থানে খামারিরা বাড়ি বসেই দুধ বিক্রি করতে পারেন। ঘোষরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ কিনে চিলিং সেন্টারে সরবরাহ করেন।
তিনি জানান, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার লাহিড়ী মোহনপুর এলাকায় সরকারি ২৭ কোটি টাকা সরকারি অর্থ সহায়তা ও মিল্কভিটার অর্থায়নে একটি গো-খাদ্য প্লান্ট করা হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের সমবায়ী গো-খামারিরা ন্যায্যমূল্যে সুষম গো-খাদ্য ক্রয় করে সার্বিকভাবে লাভবান হচ্ছিলেন। সেখান থেকে খামারিরা গোখাদ্য কিনে একমাস পরও টাকা দিতে পারতেন। তাদের দেয়া দুধের টাকা থেকেও মিল্কভিটা গো-খাদ্যের টাকা সমন্বয় করে দিত। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো গত তিনমাস ধরে সেখানে কোনো গো-খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে না। নানা অজুহাতে বন্ধ রাখা হয়েছে।
‘এ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে খামারিদের গো-খাদ্য কেনায় সহজেই সাবসিডি দেয়া সম্ভব। কারণ এখানে যারা দুধ দেবেন তারাই সাবসিডিতে গো-খাদ্য কিনতে পারবেন। এতে কোনো ভুয়া খামারির কম দামে গো-খাদ্য কেনার সুযোগ থাকবে না। খামারিদের লাভবান করতে এ প্রতিষ্ঠানটিকে সরকার ব্যাপকভাবে কাজে লাাগতে পারে। খামারিরা সাশ্রয়ী দামে গো-খাদ্য কিনতে পারলে ভোক্তা এবং উৎপাদনকারী উভয়েই উপকৃত হবেন’, বলেন হাসিব খাঁন তরুণ।
নদী বন্দর / পিকে