বংশ পরম্পরায় কচুর লতি চাষ করছেন কুমিল্লার বরুড়ার কৃষকেরা। গত চার বছর ধরে কচুয়ার কচুর লতি রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ ২৫টি দেশে রফতানি হচ্ছে এই লতি।
রফতানি বাড়ায়, ধানের চেয়ে লাভজনক, কম খরচে অধিক ফসল ও দীর্ঘসময় ধরে ফলন হওয়ায় পূর্বের চেয়ে তুলনামূলকহারে কচুর আবাদ বাড়ছে এ উপজেলায়। স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে ২০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে কচুর লতি, ২০২১ সালে চাষ হয়েছে ২৫০ হেক্টরের বেশি জমিতে।
এখন ভরা মৌসুম। বর্তমানে প্রতিদিন ৮০টন কচুর লতি বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি গড়ে ৩০টাকা দরে বিক্রি করছেন কৃষকরা। মোট উৎপাদিত লতির ১০ শতাংশ বিদেশে রফতানি হয়। এদিকে উপজেলার নারীরাও সম্পৃক্ত হয়েছেন কচুর লতিতে।
কৃষকরা জমিতে গিয়ে লতি সংগ্রহ করেন। সেই লতি বাড়িতে নিয়ে স্তূপ করেন। লতি পরিষ্কারের কাজ করেন নারীরা। প্রতি কেজিতে এক টাকা করে পান বরুড়ার নারীরা। দিনে গড়ে ১০০ কেজি লতি পরিষ্কার করেন তারা।
গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি কচুর লতি পরিষ্কার করে স্বামীর আয়-রোজগারে অংশীদার হন, জোগান সন্তানদের পড়াশোনার খরচ। নরীন গ্রামের ফাতেমা আক্তার জানান,‘বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। স্বামী মাঠে কাজ করেন। লতি পরিষ্কার করে যে টাকা পান, তাতে সংসারে টুকিটাকি খরচ মিটে যায়।’
উপজেলার আগানগর, ভবানীপুর ও দক্ষিণ খোশবাস ইউপিতে বেশি কচু চাষ হয়। অন্যান্য ইউপিতে কচুর চাষ হলেও তা তুলনামূলক কম। এ উপজেলায় দুই ধরনের কচু বেশি চাষ হয়। একটি কচু লতি (কচু রাজ) আর অন্যটি পানি কচু (স্থানীয় ভাষায় বরিশাইল্যা কচু)। কচু রাজে শুধুমাত্র লতি হয়।
পানি কচুর লতি ও লতির ফলন শেষ হলে পুরো গাছসহ বিক্রি হয়। অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝিতে বরুড়ায় রোপণ শুরু হয় কচু গাছের। মাঘ মাস পর্যন্ত ধাপে ধাপে রোপণ করা হয় কচু গাছ। লতি রাজের চেয়ে পানি কচু রোপণ শুরু হয় তাড়াতাড়ি। ফলন শুরু হওয়ার পর একটানা ৮ মাস লতি পাওয়া যায়।
মাঘ মাসে লতি কিছুটা কম পাওয়া গেলেও চৈত্র মাসে এর ফলন দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়। শীতকালীন সবজির আধিক্য কমে যাওয়ায় এসময়ে দামও পাওয়া যায় বেশি। কৃষকরা জানিয়েছেন, সব মৌসুম মিলিয়ে গড়ে প্রতি কেজি লতির দাম পড়ে ২৫ টাকা করে। গাছসহ কচুর দাম পড়ে প্রতি কেজি ২০ টাকা করে।
কচু লতি চাষে প্রতি শতকে খরচ পড়ে ৮০০ টাকা, পানি কচু চাষে প্রতি শতকে খরচ পড়ে এক হাজার টাকা। স্থানীয় কৃষকরা লতি তুলে বাড়িতে নেন; সে লতি পরিষ্কার করে আটি বাঁধেন নারীরা। আটি বাঁধা শেষ হলে স্থানীয় ব্যাপারীরা নগদ টাকা দিয়ে লতি কিনে নেন।
তারপর ছোট ছোট ভ্যানে করে উপজেলার বিজয়পুর, আড়াওটি, বাতাইছড়ি, সরাপতি, মুগুজি, বারইপুর গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে স্তূপ করা হয়। সেখান থেকে পিকআপ ভ্যানে করে কচুর লতি নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম ও কৃমিল্লার নিমসারের আড়তদারদের কাছে।
ছোট-বড় ৫০জন ব্যাপারী কচুর লতি সংগ্রহ করেন। কুমিল্লার বুড়িচংয়ের নিমসারে কচুর লতি বিক্রি করার জন্য আলাদা কর্নার রয়েছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকার আড়তদারদের কাছে বিক্রি হওয়া লতির একটি অংশ অ্যাজেন্সির মাধ্যমে চলে যায় ইতালি, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে।
ইতালি ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশে কুমিল্লার বরুড়ার লতির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে দিনে একটন লতি বিদেশে রফতানি হয় বলে জানা গেছে।
এ ছাড়াও কুমিল্লা থেকে ২০২০ সালে দেড় লাখ চারা দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয়েছে। ২০২১ সালে এক লাখ চারা বিক্রি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লতি রাজের চারা ৩ টাকা ও পানি কচুর চারা ৪টাকায় বিক্রি হয়।
চারা রোপণের পর ভাদ্র মাসে গাছের মূল থেকে নতুন চারা গজায়। সে চারা বিক্রি হয়; আবার একই চারা দিয়ে বরুড়ার কৃষকরা নতুন নতুন জমি আবাদ করেন। বরুড়ার আগানগরের কৃষক সেলিম মিয়া ৫০বছর ধরে কচু চাষ করেন।
এবার ১৭ শতক জমিতে কচু রাজ লাগিয়েছেন তিনি। খরচ হয়েছে ১০হাজার টাকা। তিনি জানান, এ জমি থেকে ৩০ হাজার টাকার লতি বিক্রি করবো। কচু চাষে লোকসান হয় না বললেই চলে, ফলনও হয় লম্বা সময় ধরে- তাই কচু চাষ করছি।’
উপজেলার দক্ষিণ জগদেশর গ্রামের কৃষক সানাউল্লাহ জানান, ১৮ শতক জমিতে পানি কচু চাষ করেছি। ১৬হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সবমিলিয়ে ৬০হাজার টাকার লতি ও গাছ বিক্রি করতে পারবো।’ তিনি আরও জানান,‘সহজে কৃষি ঋণ পেলে ও কৃষি কর্মকর্তাদের আরও আন্তরিকতা থাকলে এ পেশায় আরও বেশি মানুষ সম্পৃক্ত হতো।’
আড়াওটি গ্রামের ব্যাপারী ছফিউল্লাহ বলেন, ‘এখন অফ সিজন, তারপরও দিনে আড়াই টন কচুর লতি চট্টগ্রামের আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন তিনি। একমাস পর ভরা মৌসুম আসলে দাম ও বিক্রি দুটোই বাড়বে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারের কন্দাল (মাটির নিচে যেসব উদ্ভিদের ফলন হয়) প্রকল্পের অধীনে বরুড়ার কচু চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথমে কমসংখ্যক চাষিকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। ধীরে ধীরে অন্যান্য চাষিদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
বরুড়া উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম জানান, ‘কৃষকরা চাইলে তাদের জন্য সহজ ঋণের ব্যবস্থা করবো। উপজেলার নারী-পুরুষ সবাই এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে-এটা বেশ আনন্দদায়ক।’
বরুড়ার নির্বাহী কর্মকর্তা আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘বরুড়া বাংলাদেশের কৃষিতে দারুণ ভূমিকা রাখছে। কচুর লতি রফতানি ও বিপণন বিষয়ে কৃষকদের সর্বোচ্চ সহায়তা করবে উপজেলা প্রশাসন।’
নদী বন্দর / এমকে