‘আমার দাদাও বলতে পারেনি তেঁতুল গাছটির বয়স কত! খুব ভয়ঙ্কর জায়গা তেঁতুলতলা। ওখানে প্রসাব-পায়খানা তো দূরের কথা, ওই গাছের শুকনো ডাল পড়ে গেলেও কেউ কুড়িয়ে তা চুলায় দিতে ভয় পায়। এমনকি কেউ ওই গাছের তেঁতুল পেড়ে বিক্রি করলেও তার খবর আছে’
কথাগুলো বলছিলেন, হরিয়াণ ইউনিয়নের মেম্বার ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আক্কাস আলী।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাছটি প্রায় দেড় বিঘা জমির উপর বিস্তৃত ডালপালায়। পুরো গাছটি সবুজ পাতায় ভরপুর। পাতার মাঝে বিভিন্ন ডালে ডালে ঝুলে আছে পুরোনো তেঁতুল যা কেউ পাড়েননি। এছাড়াও গাছটিতে ফুটেছে নতুন ফুল ও ছোট ছোট কলি।
রাজশাহী পবা উপজেলায় হরিয়াণের দহপাড়া গ্রামেই রয়েছে তেঁতুলতলা বাজার। মূলত ‘তেঁতুলতলা’ বাজারটির নামকরণ হয়েছে একটি শতবর্ষী তেঁতুল গাছের কারণে। কেউ-ই সুনির্দিষ্টভাবে জানেন না গাছটির বয়স! এই গ্রামে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই জানে তেঁতুল গাছের নানান ঘটনা। যা শুনলে গা শিউরে ওঠে।
স্থানীয়রা জানান, অনেকেই এই গাছ নিয়ে স্বপ্ন দেখলে মানত করেন। মানত করে গাছের তলায় রেখে যান দুধ, কলা, মিষ্টি, গরু, খাসি ও মুরগি। সেগুলো স্থানায়ীদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়।
শতবর্ষী এই তেঁতুল গাছটি তার প্রকান্ড ডাল-পালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে চারদিকে। একটা সময় এই রাস্তায় ভয়ে কেউ যাতায়াত করতেন না। তবে কালক্রমে আশপাশে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, দোকান-পাট। তেমনি একটি ডাল প্রসারিত হয়ে রাস্তার ওপার চলে গেছে। সেখান দিয়ে নির্মাণ হয়েছে একটি মার্কেট। মার্কেটের একটি দোকান রয়েছে ফাঁকা। সেই ফাঁকা দোকানটিতে ঢুকে রয়েছে তেঁতুল গাছে একটি বড় ডাল।
দোকান ঘরটির এই অবস্থার কারণ জানতে চাইলে ওই এলাকার বাসিন্দা সাবাজ মন্ডল বলেন, ‘ডাল কাটলে খবর আছে। আমারই এক বংশের লোক এই গাছের একটি ডাল কেটেছিল। কয়েকদিনের পর তার পায়ে পচন ধরে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তার গোটা পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। পরে বেচারা মারাই গেল।’
তেঁতুল গাছের পাশেই মিল রয়েছে মাইনুল ইসলামের। ২৫ বছর ধরে চালাচ্ছেন মিলটি। তিনি বলেন, ‘আমার বাপ-দাদা এমনকি বড় আব্বারাও (বাবার দাদা) বলতে পারেনি গাছের বয়স। বহু পুরোনো গাছ এটি। এই গাছকে নাড়লেই ক্ষতি, অন্যথায় কিছুই হবে না।’
তিনি প্রতিবেদককে টেনে দেখান একটি কাটা ডাল। সেই ডালটির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সুগারমিলের রহমান ড্রাইভার গাছের ডালটা কেটেছিল। তার এখন মাথার ঠিক নাই, পুরাই পাগল। গাছের বিষয়ে বললে আরও রেগে যায়। তার সাথে আমার মিলের নীরা নামের এক মিস্ত্রি গাছ কাটতে সাহায্য করেছিল, তারও সমস্যা হয়েছিল। পরে মাফ চেয়ে সে এখন ঠিক আছে।’
গাছ থেকে তেঁতুল নামানো বা বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবের আলী বলেন, ‘গাছ থেকে তেঁতুল নামিয়ে খেলে কোনো সমস্যা নাই। যত খুশি পাড়তে পারবেন, খেতে পারবেন, বিলাতে পারবেন কিন্ত এই গাছের তেঁতুল বিক্রি করতে পারবেন না। একবার এক লোক এই গাছের একটা মধুর চাক কেটেছিল। দু’দিনের মধ্যে সে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যায়।’
এই বক্তব্যে সায় দিয়ে গ্রামের দিনমজুর মুকুল জানান, তেঁতুল পেড়ে বিক্রি করায় একলোক মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যেতে লেগেছিল। পরে ওই গাছের কাছে মাফ চায়, আর ভুল স্বীকার করে। তারপর সে ঠিক হয়। আমিও সেদিন তেঁতুল পেড়েছিলাম। কিন্তু আমি বিক্রি করিনি, তাই আমার কিছু হয়নি।’
হরিয়ান ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার সাবের আলী মন্ডল। বর্তমানে তেঁতুলতলা বাজারে রয়েছে তার সার ও কীটনাশকের দোকান। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাপ দাদারাও এই গাছের বয়স জানে না, আমরা কি করে বলব বলেন! আমার দাদা ১১০-১২০ বছর বেঁচেছিল। তারাও বলতে পারেনি গাছের বয়স। আমাদের দাদার দাদারাও বলেছে, এই গাছ আজ যেমন দেখছিস, আমাদের দাদার আমলেও ঠিক তেমনই ছিল।’
১৯৭১ সালের দিকে অলৌকিক এক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হান্নান। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মিলিটারিরা একটা গাড়ি নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে যেতে লেগে তেঁতুল গাছটায় তাদের গাড়ি বেঁধে যায়। এতে কয়েকজনকে এই গাছের ডাল কাটার অর্ডার দেয় তাদের কমান্ডার। গাছের সাতটা ডাল তারা কাটেন। যে চারজন ওই ডাল কেটেছিলেন তাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক অসুখ দেখা দেয়। দু’জন বুকধড়ফড় করে সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। বাকি দু’জনেরও অবস্থাও খারাপ হয়ে মারা যায়।’
রাজশাহী সুগারমিলের এসবিএ পদে চাকরি করেন মো. আক্তার হোসেন। ১৯৭৯ সালে তিনি গাছে চড়েছিলেন। গাছে চড়ার আগে গাছতলায় থাকা মানতের দুধ আর কলা খেয়েছিলেন। তারপর গাছে চড়ে তেঁতুলসহ পেড়েছিলেন গাছে থাকা দু’টি ঘুঘু পাখির ডিম। গাছা থাকা অবস্থাতেই দেখেন একটি ঘুঘু। পাখিটি হাতের খুব কাছে চলে আসে। সেটিকে বারবার ধরার চেষ্টা করে পড়ে যান গাছ থেকে। তারপর সঙ্গাহীন বিছানায় কাটিয়েছেন দুই বছরের বেশি। নাক দিয়ে তরল খাবারেই কাটাতে হয়েছে তাকে দু’টি বছর। মুখে সেলাই পড়েছে, মুখটাও বাঁকা হয়ে গিয়েছিল ওই ঘটনায়।
অলৌকিক কিছু দেখেছেন কিংবা ঘুমের মধ্যে কোনো স্বপ্ন দেখেছেন কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ দেখেছিলাম। বিছানা অজ্ঞাত অবস্থা ও কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরও নারী কণ্ঠে আমাকে ডাকত। আমিও ঘোরের মধ্যে ছুটে চলে যেতাম নাকি। আমাকে বাড়ির লোক বা স্থানীয়রা অনেক বার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। ঠিকভাবে ঘুমাতে পারতাম না। বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম আমার দাদার বাড়ি। সেখানেও একই সমস্যা হতো। পরে ক্ষমা চাই এসব বিষয় নিয়ে আর দু’টি কালো খাসি মানত দেই। এখন আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।’
আক্তার হোসেনের কথাশুনে পাশের এক দাঁড়িয়ে থাকা যুবক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মায়ের কাছে শুনেছি, আমার মামা একবার ওই গাছের আশপাশে বসে প্রসাব করেছিল। তারপর সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। তারপর কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যান।’
হরিয়াণ তেঁতুলতলার মেম্বার মো. আক্কাস আলী শোনান বেশ কয়েকটি গা শিউরে ওঠার মতো অদ্ভুদ ঘটনা।
তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৯৭৫ থেকে ৭৬ সালের দিকে গাছটা প্রায় শুকিয়ে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। পাশেই একটি ভাটা ছিল। তখন ওই ভাটার মালিক স্বপ্নে দেখে এখান থেকে ভাটা না সরিয়ে নিয়ে তার ক্ষতি হয়ে যাবে। স্বপ্নপ্রাপ্ত আদেশে ভাটামালিকে চলে যান এলাকা ছেড়ে। তখন আবার গাছটি প্রাণ ফিরে পায়, আবার ডালপালা সবুজ হয়ে উঠে।’
গাছের তলায় অনেকেই এখন বসে থাকেন। তাই চেয়ারম্যানের পরামর্শে গাছের পাড়টি টাইলস দিয়ে বাঁধানোর কাজে হাত দেয়। বালু আর সিমেন্ট মিশিয়ে স্যালোমেশিন দিয়ে পানি দেয়, কিন্তু পানি আর ভেজে না। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পানি যায় হুড়হুড় করে, তারপর বালু ভেজে না। উপস্থিত আমরা সবাই অবাক হয়ে যায়। পরে ওই বালু আর সিমেন্টে পানি ছিটিয়ে তা ভেজানো হয়। অথচ, যে পানি গেছে তাতে দু’তিনটা বিল্ডিং এর কাজ করা যেত।
হান্নানের সেই মিলিটারি গায়েব হওয়ার ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমি তখন হাফপ্যান্ট পরা ছেলে। মিলিটারিরা এদিক দিয়ে ৩-৪টা বড় ট্রাক নিয়ে যাচ্ছিল। পথে তেঁতুল গাছের ডাল থাকা তারা সেটা কেটে ফেলেন। এতে ঘটনাস্থলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যান। পরে এই তেঁতুলতলার পথ দিয়ে শুধু ড্রাইভার খালি গাড়ি নিয়ে যায়। তারাও বলতে পারেননি ওই মিলিটারিদের হদিস। কেউ বলে মুক্তিযোদ্ধারা মেরেছে, কেউ বলে গায়েব হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেই সুগারমিলের ড্রাইভার আব্দুর রহমান আমার মামা তেঁতুলতলার পাশে একটি সরার গাছ বেঁচেছিলেন। গাছ বিক্রির কারণে তিনি পা কাটা পড়ে কষ্টে মারা যান। আবার যে এই গাছটি কিনেছেন তারও শুনেছি ক্ষতি হয়েছে। সেও মারা গেছে।’
শতবর্ষী গাছটির উপর দিয়ে চলে গেছে বিদ্যুতের তার। তারপরও বিদ্যুত বিভাগ থেকে এই গাছের ডালপালা কাটেন না। তারাও জানেন এই গাছের ভয়ঙ্কর সব কল্পকথা।
তবে মেম্বার আক্কাস আলী জানান, একবার পবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এলাকায় এসে এই গাছ কাটার কথা বলেন রাস্তা বড় করার জন্য। তিনি তাতে পরিষ্কার জানিয়ে দেন ‘স্যার আমি মেম্বারশিপ ছেড়ে দেব তাও এই কাজ আমি করতে পারব না। আপনি করতে যেয়েন না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে সবার কাছে থেকে এই গাছের ঘটনা শুনে নিয়েন।’ অতপর পবা ইউএনও আর গাছটি কাটেননি।
মেম্বার আক্কাস আলী বলেন, তেঁতুলগাছ ততক্ষণ না কাউকে কিছু বলে, যতক্ষণ কেউ তার ক্ষতি করে। এমনিতেই সেই গাছ নিয়ে কোনো সমস্যা হয় নাই। তবে তার সিস্টেমের বাইরে গেলে খবর আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আহম্মদ নিয়ামুর রহমান বলেন, এমন কোনো গাছের কথা আমি কখনও শুনিনি। তবে এমন ঘটনার বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসব ঘটনার ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট। একজন মুসলিম হিসেবে আমি নিজেও বিশ্বাস করি পৃথিবীতে জিন ও মানুষ উভয়ের বসবাস রয়েছে। তাই এসব ঘটনা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, এই ধরনের শতবর্ষী গাছ সংরক্ষণের কোনো নীতিমালা বন বিভাগের রয়েছে কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা রয়েছে। কিছু কিছু ঐতিহাসিক ও পুরোনো গাছের সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বন বিভাগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। আমি ওই স্থানটি পরিদর্শন করব। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরে চিঠির মাধ্যমে শতবর্ষী গাছটি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।
নদী বন্দর / পিকে