ফরিদপুরে এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে কপাল পুড়েছে পদ্মা ও মধুমতী নদীর চরের বাদামচাষিদের। রোপণের পর প্রখর খরায় শুকিয়ে যাওয়ার পর ক্ষেতে যা ফসল ছিল তা হঠাৎ বানের পানিতে তলিয়ে গেছে বাদাম ক্ষেত। এ যেন ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন—চলতি বছর ফরিদপুরে পাঁচ হাজার ৯৫২ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়। যার তিন ভাগের দুইভাগ নদীতে পানি বাড়ায় তলিয়ে গেছে।
চাষিরা বলছেন—জেলার চরাঞ্চলের কয়েক হাজার বিঘা জমির বাদাম ক্ষেত এখন পানির তলে। অথচ এখন বাদাম তোলার সময়। এ লোকসান কাটিয়ে উঠতে তারা সরকারি সহায়তা দাবি করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুরের পদ্মা ও মধুমতী নদীর ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষগুলো চরের যেসব ফসলের ওপর নির্ভরশীল, তার মধ্যে বাদাম অন্যতম। ডিসেম্বরের শেষ সময় থেকে তারা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চরের জমিতে বাদাম রোপণ করেন। মে-জুনে জমি থেকে বাদাম তোলেন।
এবার তারা প্রতি মণ বাদামের বীজ ৯-১০ হাজার টাকায় কিনেছিলেন। এরপর সার, চাষ ও জমি তৈরিতে যা ব্যয় হয়েছে, তার পুরোটাই এবার বাদামচাষিদের লোকসান হতে চলেছে। অন্যান্য বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করেও মোটামুটি ফলন পেয়েও চাষিরা ছিলেন খুশি।
কিন্তু এ বছর বাদাম চাষ শুরুর পর থেকেই চাষিদের কপালে যেন অনেকটা শনির দশা নেমে আসে। একদিকে প্রখর খরা, অন্যদিকে হঠাৎ বানের পানি। এই দুইয়ে মিলে এবার বাদামচাষিদের স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
এবার তিন বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছেন চরভদ্রাসনের বাদামচাষি মো. পান্নু মোল্লা। তিনি বলেন, ‘বাদামের চারা বের হওয়ার পর সেচ দিতে পারিনি। প্রচণ্ড খরায় প্রথমে তা পুড়েছে। এতে জমির অনেক বাদামের চারা মারা গেছে। যা ছিল তা বানের পনিতে তলিয়ে শেষ। খরচ করা ৫০ হাজার টাকার চারআনা পয়সাও ঘরে আসেনি। সব আমার ভাগ্যের দোষ।’
একই এলাকার বাদামচাষি মো. অভি খালাসী বলেন, ‘আমি প্রায় ৪ বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছিলাম। অন্যবার মোটামুটি ভালই ফলন হয়। কিন্তু এবার প্রখর খরা আর হঠাৎ নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে সব শেষ হয়ে গেছে।’
চরভদ্রাসন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাব মণ্ডল বলেন, ‘প্রায় চার মাস অনাবৃষ্টিতে বাদাম পুড়ে যাওয়ার পর পানিতে তলিয়ে বেশকিছু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা বিষয়টি অবগত আছি। চাষিদের ক্ষতিপূরণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হবে।’
এদিকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাদাম নষ্ট হওয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বর্গাচাষিরা। রুদ্রবানা গ্রামের বর্গাচাষি ইনামুল মোল্যা, শহিদুল ইসলাম ও আব্দুল কুদ্দুস মোল্যা, চর মাকড়াইলের নুর জালাল, আপন শেখ, আমির শেখ ও খোলাবাড়িয়া গ্রামের বর্গাচাষি তারা মিয়া লোকসানের কথা জানিয়েছেন।
তারা জানান, গত বছর ৫ একর জমিতে বাদাম চাষ করে প্রায় ৬০ মন বাদাম পেয়েছিলেন। এবার তারা ৬-৭ একর জমিতে চাষ করেছেন। রোপণের সময় প্রতিমণ বাদাম বীজ ৬-৭ হাজার টাকা দরে কিনেছেন। জমি চাষ, রোপণ ও অন্যান্য খরচসহ বিঘাপ্রতি প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাদামক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় খরচের এক পয়সাও ওঠেনি।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিপন প্রসাদ শাহা বলেন, ‘এবার হঠাৎ বন্যায় কৃষকদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছ। সরকারি সহয়তা পেলে তাদেরকে দেয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আলফাডাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার একর জমিতে বাদাম চাষ হয়েছে। এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ৬০০ টন। কিন্তু পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তিন ভাগের এক ভাগ বাদামও কৃষকের ঘরে তোলার সম্ভাবনা নেই।’
ফরিদপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. হযরত আলী বলেন, ‘দীর্ঘদিন বৃষ্টির না হওয়ায় অনেকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যবারের তুলনায় ফলন কমবে। প্রচন্ড খরায় কেউ কেউ সেচ দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিলেন। তবে বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সব শেষ।’
তিনি বলেন, ‘বাদাম এমন এক ফসল—যেখানে বৃষ্টির পানি এবং সেচের বিকল্প নেই। হঠাৎ নদীতে পানি বাড়ার কারণে অনেক জায়গায় বাদাম ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও প্রণোদনার দেয়ার চেষ্টা করা হবে।’
নদী বন্দর / জিকে