1. badsha.dru@gmail.com : admi2017 :
  2. nadibandar2020@gmail.com : Nadi Bandar : Nadi Bandar
শিক্ষক বিপ্লবের শখের বশে কবুতর পালন - Nadibandar.com
মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ অপরাহ্ন
নদী বন্দর প্রতিনিধি:
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১
  • ২৭৫ বার পঠিত

কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের পানজোরা গ্রামের বাসিন্দা মো. বিপ্লব হোসেন। উপজেলার এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের পাশেই দোতলা বাড়ি। এলাকায় তাকে বিপ্লব মাস্টার বলেই ডাকেন সবাই। শিক্ষকতা করেন উপজেলার প্রাচীন বিদ্যাপীঠ সেন্ট নিকোলাস উচ্চ বিদ্যালয়ে।

আজ থেকে প্রায় ২১ বছর আগে নিতান্তই শখের বসে কবুতর পালন শুরু করেন শিক্ষক বিপ্লব। তিনি তখন ৮ম শ্রেণির ছাত্র। যে স্কুলে পড়তেন এখন তিনি সেখানেই শিক্ষকতা করেন। বাবা-মায়ের দেয়া টিফিনের খরচের টাকা থেকে বাঁচিয়ে স্থানীয় বাজার থেকে মাত্র ৪ জোড়া কবুতর কেনেন। সেই কবুতর আস্তে আস্তে সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু একদিন রাতে তার শখের কবুতরগুলো বাঘডাসে খেয়ে ফেলে। ভেঙ্গে যায় কিশোর বিপ্লবের স্বপ্ন।

jagonews24

ছাত্রাবস্থায় অতিরিক্ত কোন পয়সা ছিল না তার হাতে। তাই হঠাৎ করেই থেমে যায় শখের কবুতর পালন। কিন্তু সহজে থেমে যাওয়ার পাত্র নন বিপ্লব। বেশ কয়েক বছর বন্ধ রেখে ২০১৮ সালে নতুন করে নিজের বাড়ি তৈরির পর ছাদের ওপর ঢেউটিনের ছাউনিতে ৬ জোড়া কবুতর দিয়ে গড়ে তোলেন বর্তমান কবুতর খামারটি। এখন তার শেডে শোভা পাচ্ছে প্রায় ১০০ জোড়া কবুতর। সেই শখের কবুতর পালনে এখন আয় করার পাশাপাশি পরিবারের পুষ্টি চাহিদাও মিটছে বেশ।

সরেজমিনে পানজোরা গ্রামে শিক্ষক বিপ্লব হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দোতলা বাড়ির ছাদে একটি কাঠ ও ডেউটিন দিয়ে দুই সাইডে তৈরি কবুতরের ঘর। ভিতরে বসানো হয়েছে প্রায় শতাধিক কবুতরের খোপ। আকারে বড় বিদেশি কবুতরগুলোর জন্য রয়েছে আলাদা লোহার খাঁচা। নিচে দেয়া আছে খাবার ও স্বচ্ছ পানি।

কবুতরগুলো প্রয়োজন মতো যে যার মতো করে খাবার খাচ্ছে, আবার উড়ে গিয়ে বসছে নিজের কামরাতে। সেখানে বসে কেনোটা ডিমে তা দিচ্ছে। কোনোটা নিজের বাচ্চাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আবার কেউ অপরের সাথে হট্টগোলে ব্যস্ত। কেউ বা আবার দলবলে সাঁতার কাটছে।

jagonews24

একটি সাধারণ কবুতর বছরের ১২ মাসে ১৩ জোড়া বাচ্চা দিলেও উন্নত জাতের কবুতর সাধারণত বছরে ৩ জোড়ার বেশি বাচ্চা দিতে পারে না। তবে শিক্ষক বিপ্লব তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ১ জোড়া উন্নত জাতের কবুতরের পাশে ৫ জোড়া ফোস্টার কবুতরের সঙ্গে একটি নির্ধারিত সময়ে ডিম পরিবর্তনের মাধ্যমে বছরে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ জোড়া উন্নত জাতের কবুতরের বাচ্চা উৎপাদন করছেন।

কবুতর চাষের শুরুতে শিক্ষক বিপ্লব মাত্র ৩৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলেও এখন তার শখের কবুতর ফার্মে মূলধনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। আর বর্তমানে ১০০ জোড়া কবুতর চাষে মাসে প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা ব্যয় করে তিনি মাসিক নিট মুনাফা আয় করছেন কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা। ওই ফার্মের প্রতি জোড়া কবুতরের সর্বনিম্ন মূল্য ২ হাজার টাকা। তবে সেখানে প্রতি জোড়া ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের উন্নতজাতের কবুতরও রয়েছে। কবুতর চাষে কবুতরের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও বাসস্থানের ব্যাপারে শিক্ষক বিপ্লব তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

কবুতর চাষে বিপ্লব তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, কবুতরের বাসস্থান তৈরি করতে হলে বাড়ির ছাদে অথবা কোনো খোলা জায়গায় তাপ নিয়ন্ত্রণ উপযোগী একটি শেড নির্মাণ করতে হবে। সেখানে ছোট কবুতরের জন্য আড়াই ফুট স্কয়ার সাইজের এবং বড় কবুতরের জন্য সাড়ে তিন ফুট স্কয়ার সাইজের লোহার খাঁচায় কবুতর পালন করতে হবে। ওই খাঁচায় নিয়মিত পানি ও খাদ্য সরবরাহ করতে হবে এবং নিয়মিত শেডের ময়লা পরিষ্কার করতে হবে।

jagonews24

কবুতরের খাদ্য তৈরির ক্ষেত্রে সাদা সরিষা, গম, ভুট্টা ভাঙা, কুসুম ফুলের বিচি, মসুর কলাই, খেসারি কালাই, মুগ কালাই, মাস কালাই, রেইঙ্কল, ও বুট কালাইসহ ১১টি শস্যের সমপরিমাণ মিশ্রণে সুষম খাদ্য তৈরি করেন। তবে শীতকালে শীতজনিত রোগবালাই থেকে রক্ষার্থে কবুতরের খাদ্য তৈরির ক্ষেত্রে রেইঙ্কল, বুট ও মাস কালাই মিশ্রণ বাদ রাখেন। এ সুষম খাদ্যে কবুতরের স্বাস্থ্য সর্বদায় ভালো থাকে এবং নিয়মিত ডিম দিতে ও বাচ্চা ফুটাতে সহায়ক হয় বলে জানান তিনি।

তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই তার কবুতর পোষার স্বপ্ন ছিল প্রবল। উড়ন্ত কবুতর দেখতে তার খুব ভালো লাগত। তাই তিনি শখের বশে এ খামার গড়ে তুলেন। খামারে প্রায় ১০ প্রজাতির কবুতর রয়েছে। তার খামারে বর্তমানে কবুতরের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তিনি এসব কবুতর সংগ্রহ করেছেন।

কখনও বিনিময় পদ্ধতি অর্থাৎ, এক জাতের কবুতর দিয়ে অন্য জাতের নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে তার সংগ্রহশালা বাড়িয়েছেন। তার খামারের বাসিন্দা একজোড়া কিং কবুতরের বর্তমান বাজারমূল্য ৮ হাজার টাকা। আর একজোড়া মুক্ষী কবুতরের দাম তিন হাজার টাকা। তবে কবুতরের ওড়ার ক্ষমতার ওপর এর দাম নির্ধারণ হয় বলে জানান শখের এ খামারি।

তবে তার এই খামার কোনো বাণিজ্যিক খামার নয়। এখান থেকে তিনি কোনো রোজগারের আশাও করেন না। এটা নিতান্তই তার শখের খামার। তার মতে, কেউ চাইলে বাণিজ্যিকভিত্তিতে এমন কবুতরের খামার করতে পারেন। এর মাধ্যমে মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

jagonews24

তিনি জানান, তার ফার্মের কবুতর খুব একটা অসুস্থ হয় না। তারপরও কবুতরের চিকিৎসায় ঠান্ডা লাগা, সর্দি, কাশি, আমাশয় ও কৃমি প্রতিরোধে মানুষের জন্য তৈরি ওষুধের ৮ ভাগের ১ ভাগ প্রয়োগে এবং অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে হাঁস-মুরগির জন্য তৈরি ওষুধের ৪ ভাগের ১ ভাগ প্রয়োগ করে কবুতরের রোগ-বালাই প্রতিরোধে কার্যকর সুফল পেয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।

এছাড়াও শিক্ষক বিপ্লব কবুতরের চিকিৎসায় কালীগঞ্জ উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিসের সহযোগিতা নিয়ে নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পারায় তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি শখের কবুতর পালন করতে পারছেন।

শিক্ষক বিপ্লবের কাছ থেকে কবুতর ও পরামর্শ নিয়ে শখের কবুতর পালন করছেন স্থানীয় তামজিম খান, তাসকিন খান, সজল, সোহেল। তাদের শখের কবুতর চাষিদের ঘরে ঘরে এখন শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন রংয়ের কিং, মুক্ষী, বুম্বে, গিরিবাজ, গিয়ারছলী, মুসলদ্যম, গোল্লাসহ প্রায় ১০ জাতের কবুতর।

মাঝেমধ্যে তিনি সব কবুতর খোপ থেকে বের করে উড়িয়ে দেন। ২০০ কবুতর যখন এক সঙ্গে আকাশে ওড়ে, কোনো কোনোটি ডিগবাজি দেয় তখন তিনি কবুতর পোষার স্বার্থকতা ও আনন্দ খুঁজে পান। দৃষ্টিনন্দন এ দৃশ্য দেখে তার প্রাণ ভরে যায়। প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টায় উঠে তিনি কবুতর পরিচর্যায় হাত দেন, আর একটানা সকাল ৯টা অবধি চলে এ কাজ।

এ কাজে স্ত্রী সিলভীয়া হোসেন সুমি ও সাড়ে তিন বছরের একমাত্র ছেলে মো. সায়াদ হোসেন ছোয়াদ তাকে নানাভাবে সাহায্য করেন। তিনি বলেন, এ দু’জন না থাকলে একা এমন খামার সামলানো যেত না।

স্ত্রী সিলভীয়া হোসেন সুমি জানান, খামারের কবুতরদের বিপ্লব নিজ সন্তানের মতো লালন-পালন করেন। এই খামার তার ধ্যান-জ্ঞান। অবসরের পুরোটা সময় তার স্বামী এ খামার ও ছাদ বাগানে কাজে ব্যয় করেন। ছোটবেলা থেকে বিপ্লব কবুতর পালন করে আসছে। এজন্য অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের কাছে গালমন্দও শুনতে হয়েছে তাকে।

কিন্তু তার সখের কাজ কখনো বন্ধ করেনি সে। আজ তার বাড়িতে কবুতরের খামার করেছে। সেখান থেকে এখন বেশ পয়সাও রোজগার হচ্ছে। পাশাপাশি শখের সেই কবুতর পালনে পরিবারের পুষ্টি চাহিদাও মিটছে বেশ। বাড়ির সকলে এখন তার কাজে সহযোগিতা করছেন।

খামারের ঘরের পাশে থরে থরে সাজানো রয়েছে গম, ভুট্টা, ধান, গম ও ভুট্টার ছাল, সরষে, ডিমের খোসা, ইটের সুরকি, চুনসহ নানা জাতের খাবার। এছাড়া কবুতরগুলো সবুজ শাক-সবজি খেতেও ভালোবাসে। এ কারণে শিক্ষক বিপ্লব খামারের পাশে ছাদে নানা জাতের গাছপালা ও শাক-সবজির চাষ করেছেন। কবুতর ইচ্ছেমতো উড়ে এসব গাছের পাতা খায়। কবুতরের খুব বেশি রোগবালাই না হলেও স্থানীয় প্রাণিসম্পদ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে থাকেন তিনি।

মজার বিষয় তিনি কবুতর বিক্রি করেন না। মাঝে মধ্যে খুব পরিচিতজন কেউ অনুরোধ করলে তাদের তিনি বিনামূল্যে দিয়ে দেন। কবুতরের বাচ্চা বিক্রি করেন। পাশাপাশি এ শখের কবুতর পালন থেকে তিনি তার নিজ পরিবার ও স্বজনদের পুষ্টির চাহিদা মেটান। তবে তিনি স্থানীয় বেকার যুবকদের এই কবুতর পালনের মাধ্যমে বেকারত্ব গুচিয়ে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন।

কারণ তিনি মনে করেন কবুতর চাষ খুব লাভজনক। এতে সময় ও শ্রম দিয়ে যথাযথ পরিচর্চা করলে খুব দ্রুতই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। চাষিদের মধ্যে বিপণনে সমন্বয়ের ব্যবস্থা করে এবং সরকারি অথবা বেসরকারি উদ্যোগে চাষিদের মাঝে পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নতজাতের কবুতর চাষে উৎসাহিত করে দেশের হাজার হাজার যুবকের বেকারত্ব দূর করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকতা ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, সাধারণত রানীক্ষেত ও বসন্ত রোগে কবুতর বেশি আক্রান্ত হয়। তবে এ রোগের টিকা আমাদের প্রাণীসম্পদ অফিসে পর্যাপ্ত রয়েছে। তবে পিজন ম্যালেরিয়া রোগেও কবুর আক্রান্ত হয়। তবে এই রোগের জন্য মানুষের চিকিৎসায় যে ঔষধ ব্যবহার করা হয় তা কবুতরের ক্ষেত্রে ব্যবহার করলে ফল পাওয়া যায।

তিনি আরো বলেন, অনেক সময় দেখা যায় হাস-মুরগী বা কবুতর আক্রান্ত হলে প্রাণীসম্পদ অফিসে খামারিরা আসে। কিন্তু নিয়মানুযায়ী হাঁস-মুরগী বা কবুতরকে প্রতি ৩ থেকে ৪ মাস অন্তর অন্তর টিকা দিতে হয়। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রাণীসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে হয়।

নদী বন্দর / জিকে

 

 

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2020 Nadibandar.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com