এলাকার লোকজন কিছুটা ঠাট্টা করে বলতেন, এসব কাঁটার গাছ কেন? কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই কাঁটার গাছগুলো ফলবতী হয়ে উঠেছে। আর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কৃষক বাহার উদ্দিন শেখের গড়ে তোলা ড্রাগন বাগানটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়েছে।
শখের বসে দুই বিঘা জমি দিয়ে চাষ শুরু করলেও এখন ৪ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে খামার পরিচালনা করছেন। তার মাসে আসছে লাখ টাকা।
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার হাজিপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কৃষক বাহার উদ্দিন শেখ আগামীতে ২০ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কৃষি উদ্যোক্তা এবং এ এলাকায় একজন মডেল ড্রাগন চাষি বাহার উদ্দিন শেখ বলেন, শিক্ষকতা জীবনে বিরাট সম্পদ গড়তে পারেননি। স্বল্প আয়েই চার ছেলে ও দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। ৬-৭ বছর আগে অবসরের পর আয় আরো কমে যায়। তখন কৃষি কাজই পুরোদমে শুরু করেন। ধান, পাট, গম চাষ শুরু করেন। কিন্তু খরচের তুলনায় দাম না পাওয়ায় তিনি হতাশ ছিলেন। এরই মধ্যে তার এক ছেলে তাকে ড্রাগন চাষের কথা জানান।
টেলিভিশনে বিভিন্ন প্রতিবেদন দেখে তিনিও উৎসহিত হন। শুরুতে সামান্য কিছু চাষ করেন। ২০১৭ সালে দুই বিঘা জমির উপর বাণিজ্যিকভাবে ৫৫০টি ড্রাগনের চারা রোপণ করে গড়ে তোলেন ভিয়েতনামি ফল ড্রাগনের এক খামার। ফলন ও উৎপাদন বেশি হওয়ায় পরে জমির পরিমাণ বাড়ান আরো দুই বিঘা। এখন তার ৪ বিঘার বাগানে লাল, সাদা, হলুদ, কালো ও গোলাপি মোট ৫ জাতের ১০০০টি ড্রাগন ফলের গাছ রয়েছে।
তার বাগানের ড্রাগন গাছকে ওপরের দিকে ধরে রাখার জন্য সিমেন্টের কিংবা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয়েছে। ড্রাগনের চারা বা কাটিং রোপণের ১০ থেকে ১৫ মাসের মধ্যেই ফল সংগ্রহ করা যায়। তিনি জানান, শুরুর দিকে লোকজন তার ড্রাগন চাষ করাকে ‘পাগলামো’ বলতেন। তারাই এখন তার সাফল্য দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন। তারাও ড্রাগন চাষে এগিয়ে আসছেন।
বাহার উদ্দিন শেখ বলেন, ড্রাগনের ভালো ফলন পাচ্ছেন তিনি। এখন প্রতি সপ্তাহে প্রায় পাঁচ মণ করে ড্রাগন ফল বিক্রি করতে পারছেন যা বাজারে পাইকারি কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা দরে। এ ছাড়াও এখন প্রতিদিন তার খামার থেকে বিক্রি হচ্ছে ড্রাগ গাছের চারা।
প্রতিটি ড্রগনের চারা বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা দরে। এ বছর করোনার মধ্যে ক্রেতাদের চাহিদা প্রচুর বলে জানান। সব মিলিয়ে (ফল এবং কাটিং বা চারা) বছরে ১০-১১ লাখ টাকার বেশি আয় করছেন। এ হিসেবে মাসে প্রায় লাখ টাকার মতো আয়। এমন সফলতা দেখে অনেকেই তার কাছ থেকে চারা কিনছেন, ছোট-বড় খামার করছেন।
আটঘরিয়া উপজেলার মাজপাড়া গ্রামের জহুরুল ইসলাম নামের এক সৌখিন চাষি বলেন, বাহার মাস্টারের ড্রাগন বাগান দেখে উৎসাহী হয়ে তার কাছ থেকে পাঁচ হাজার চারা নিয়ে পাঁচ বিঘা ড্রাগন ফলের বাগান করেছি।
জহুরুল ইসলাম আরো বলেন, ড্রাগন খামার দূর থেকে দেখলে মনে হয় সযত্নে ক্যাকটাস লাগিয়েছে কেউ। ড্রাগন মৌসুমে বাাগনে গেলে চোখ জুড়িয়ে যায় বাহারি রঙের ফুলে ভরা খামার দেখে।
আটঘরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রোখশানা কামরুন্নাহার বলেন, বাংলাদেশে ড্রাগন ফলের চাষ এখনো সেভাবে শুরু হয়নি। আটঘরিয়া উপজেলায় বাহার উদ্দিন নামে একজন শিক্ষিত চাষি এ ফলের চাষ শুরু করেছেন। তিনি সফল হয়েছেন বলেও তারা জানেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ ব্যাপারে আগ্রহীদের জন্য চাষ পদ্ধতি সম্বন্ধে জানান, জমি ভালোভাবে চাষ করে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৩ মিটার হলে ভালো হয়।
ড্রাগন ফলের চারা রোপণের জন্য ২০-৩০ দিন আগে প্রতি গর্তে ৪০ কেজি পচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি ১০০ গ্রাম করে এবং জিপসাম, বোরন ও জিংক সালফেট ১০ গ্রাম করে দিয়ে, গর্তের মাটি উপরে-নিচে ভালোভাবে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। ক্যাকটাস গোত্রের গাছ বলে বছরের যে কানো সময়ই ড্রাগন লাগানো যায়। তবে এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে লাগানো ভালো বলে তিনি জানান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরো জানান, বাংলাদেশে ১২ থেকে ১৮ মাস পর একটি গাছ ফল ধারণ করে। ড্রাগন ফল চাষে পানি খুব কম লাগে। শুকনো মৌসুমে অবশ্যই সেচ ও বর্ষা মৌসুমে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হয়। ড্রাগন ফলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় খুব একটা চোখে পড়ে না। ফল আসা শুরু হয় জুন মাসে এবং নভেম্বর মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়। পাকা ফল ফ্রিজিং বাদেই ১৫ দিন ভালো থাকে।
বাহার উদ্দিন শেখ বলেন, প্রথম বছরে খুব বেশি লাভ না পেলেও পরের বছর নিজের উৎপাদিত চারা দিয়ে ৪ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করে আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হয়েছি। ৪ বিঘা জমি থেকে প্রতি বছর খরচ বাদে গড়ে প্রায় ৯-১০ লাখ টাকার ফল বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কাটিং ( চারা) বিক্রি করে আয় হচ্ছে লাখ টাকার বেশি।
এ জন্য তিনি আরো ২০ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি পাবনায় ড্রাগন ফল বিক্রির পাশাপাশি এলাকার কৃষকদের মাঝে এই ফলের চাষ ছড়িয়ে দিতে চান। এলাকায় ড্রাগন চাষ ছড়িয়ে দিতে তিনি অন্যদের প্রায় পাঁচ হাজার চারা দিয়েছেন বলে জানান।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুল কাদের বলেন, বাহার উদ্দিনের ড্রাগন চাষের সফলতা দেখে অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছেন। তার দফতরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা আগ্রহীদের ড্রাগন চাষে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছেন। টেবুনিয়া হর্টিকালচার সেন্টারে চারা বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নদী বন্দর / বিএফ