পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার বক্তারপুর গ্রামের চাষি শাহজাহান আলী বাদশা বাণিজ্যিকভিত্তিতে আতা ফল চাষ করে বাজিমাত করেছেন। আতা ফলকে দেশের বিভিন্ন জেলায় শরিফা ফল বা মেওয়া ফল বলা হয়।
আজ থেকে ১৫ বছর আগে বাণিজ্যিকভিত্তিতে এ বাগানটি শুরু করেন বাদশা মিয়া। এখন এ বাগানের আয়তন ৪০ বিঘা। ২০১২ সাল হতে তিনি এ বাগান থেকে ফল পাওয়া শুরু করেন। এখন তার বাগান থেকে পরিপূর্ণ ফলন যাচ্ছে। বাজারে ফল বিক্রি করে ভালো দাম পাচ্ছেন।
আতা ফল চাষে বাদশা মিয়া উদ্ব্দ্ধু হলেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, বিলুপ্তপ্রায় দেশি ফলকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছা থেকেই বাণিজ্যিকভিত্তিতে শুরুতে এক একরের বাগান গড়ে তুলেছিলেন। তার বাগানই দেশে বাণিজ্যিকভিত্তিতে গড়ে তোলা প্রথম আতা ফল বাগান বলে দাবি করেন তিনি। দীর্ঘ ১৫ বছরে তা ৪০ বিঘার বাগানে রূপ নিয়েছে। শ্রমে-ঘামে তিনি আতা ফলিয়েছেন।
আতা ফল বাগান নিয়ে বাদশা মিয়া জানান, ১৫ বছর আগে ২০০৬ সালে ঢাকার বায়তুল মোকারম এলাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে তিন কেজি আতা ফল কিনেছিলেন। প্রায় হাজার টাকার ঐ ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে চারা করেন।
সেই চারা দিয়েই তার বাগান শুরু। তিন মাস বয়সী চারা ক্ষেতে লাগানোর পাঁচ বছর পর থেকে তিনি ফল পাওয়া শুরু করেছেন। শুরুর দুই বছর সীমিত আকারে ফল পেয়েছিলেন। এখন সব গাছ পরিপূর্ণতা পেয়েছে। সব গাছ থেকে পূর্ণ ফলন পাচ্ছেন।
বাদশা মিয়া জানান, বৈশাখ মাসে ফুল আসে আর ভাদ্র মাসে ফল সংগ্রহ করা যায়। আতা ফল চাষের উৎপাদন খরচ ও লাভ সম্বন্ধে জানতে চাই বাদশা মিয়ার কাছে। তিনি জানান, উৎপাদন খরচ বলতে চারা লাগানো, যত্ন-পরিচর্যা সব কিছু মিলিয়ে বিঘা প্রতি ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়।
ফলন পাওয়ার আগে অর্থাৎ ৫-৬ বছর পর্যন্ত সাথী ফসল হিসেবে ওল কচু ও অন্যান্য শাক-সবজি আবাদ করা যায়। এ দিকে বিঘা প্রতি ২০০ গাছে গড়ে একশ-দেড়শ ফল ধরে। গাছ প্রতি গড়ে একশ, ফল হিসেব করে বিঘা প্রতি অন্তত দুই লাখ টাকা লাভ থাকে বলে তিনি জানান।
বাদশা মিয়া জানালেন, বাগানের গাছের উচ্চতা ৭ থেকে ৮ ফুট থাকলে ভালো হয়। উচ্চতা এর চেয়ে বাড়ানো যায়। তবে উচ্চতা একটু কম থাকলে ঝড়ে ডালপালা ভেঙে যাওয়া আশঙ্কা কম থাকে। যত্ন-পরিচর্যা সম্বন্ধে তিনি জানান, আগাছা দূর করা ও সার দেয়া ছাড়া তেমন যত্ন-পরিচর্যা করতে হয় না। কাটিং করে গাছের আকৃতি ছোট রাখা যায়।
রোগ-বালাইয়ের মধ্যে মিলিব্যাগ নামক ছোট ছোট পোকার আক্রমণ দেখা যায়। তবে প্রতিষেধক দ্বারা সহজেই তা দমন করা যায়। পাকা আতা ফল পাখি খেতে আসে। এ জন্য পাকা ফল দ্রুত তোলাই ভালো। ফল পাকলে এটি সাদা হয়।
আতা ফল চাষকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ও সময়োপযোগী হিসাবে বর্ণনা করলেন এই চাষি। একদিকে অল্প জমিতে যে কেউ বাণিজ্যিকভিত্তিতে এর চাষ করে লাভবান হতে পারে। বাদশা মিয়া আরও জানান, তিনি ঢাকাতে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। খুচরা দাম আরো বেশি। আর্থিক লাভবান হওয়ার পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় এই ফলটি টিকে থাকলে জনসাধারণের পুষ্টির চাহিদা বহুলাংশে মিটবে।
আতা ফল বাগানকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়েছে। এখানে কর্মরত শ্রমিক মান্নান সর্দার জানান, তিনি বাদশা মিয়ার খামারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। আতা ফল বাগানের শুরুতেই তিনিসহ কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছেন বলে জানান।
গাছে সেচ সার দেয়া থেকে শুরু করে গাছের ডালপালা ছাঁটাই এবং ফল পাহারা দেয়ার কাজও তারা করেন। মৌসুমজুড়ে ফল পরিবহন করার জন্য কাজ করেন ভ্যানচালক মো. সুজন অফালী। সুজান জানান, তিনি প্রতি ট্রিপ হিসেবে টাকা পান।
বাগানের কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করে তরুণ শাকিল হোসেন। তিনি বাগানের গাছের দেখাশোনা, শ্রমিক ব্যবস্থাপনা, সেচ ও সারের জন্য ব্যবস্থা করা বা ঢাকায় মাল পরিবহনের কাজটি দেখভাল করেন।
আতা ফল বাগান দেখতে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ আসেন। পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ জিন্নাহ আল মামুন জানান, পুলিশে চাকরি হওয়ার পর প্রশিক্ষণের সময় ট্যুরের অংশ হিসেবে বেশ কয়েকবছর আগে এ খামারে এসেছিলেন।
এবার পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনি ছুটির বিকেলে আসেন খামারটি দেখতে। তিনি জানান, কয়েক বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, উন্নয়ন হয়েছে। খামারে অন্যান্য ফল বাগানসহ আতা বাগানটির পরিধি বেড়েছে। তিনি আরও জানান, বাগানটি ঘুরে দেখাও বেশ আনন্দের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক আবদুল কাদের জানান, বাদশা মিয়া আতা বাগানটি যখন শুরু করেন তিনি তখন ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ছিলেন। তাই তিনি বাগানটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত।
তিনি জানান, দেশীয় প্রজাতির এ ফলটি যেমন শরীরের জন্য খুবই উপকারী তেমনি এর চাষ করাও লাভজনক। পাবনা জেলা শহরের ফলের দোকানেই প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় এর দাম আরো বেশি। তিনি জানান, পাবনা অঞ্চলের মাটি এ ফল চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
নদী বন্দর / বিএফ