দক্ষিনাঞ্চলের জনগনের দু:খ ভবদহ। এই এলাকার লাখ লাখ কৃষক অনাবাদি বিলের দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে বসে আছে। যখন সারাদেশের কৃষক যখন মনের আনন্দে তাদের উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত তখন তারা অনাবাদি বিল গুলির দিকে চেয়ে চেয়ে চোখের জল ফেলছে এই এলাকার কৃষক। কারণ গত কয়েক বছর কৃষকের ঘরে কোন নতুন ফসল ফলেনি কিন্তু এবছর অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের সরকার,স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএডিসি-এর ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে পরিচালিত সেচ প্রকল্পের দিকে চেয়েছিল।
কিন্তু সব আশার গুড়ে বালি ঢেলে ভবদহ এলাকার হাতে গুণা কয়েক বিলে ফসল উৎপাদিত হলেও ২৭ টি বিলের মধ্যে ২১ বিলের অনাধিক ৫০ হাজার হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে আছে। যশোর-খুলনার ২৭ বিলের পানি আটকে বিভিন্ন মাছের ঘের করায় আবারও জলাবদ্ধতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ভবদহ অঞ্চলে। যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরার কয়েকটি উপজেলার ৫৯০ গ্রামের প্রায় সাত লাখ মানুষ এখন সেই শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। ইতোমধ্যে কেশবপুরের কাদার বিল, বোয়ালিয়া বিল ও সরসকাটি বিলে ঘের করার চেষ্টাকালে স্থানীয় জনতা তা প্রতিরোধ করে। বর্তমানে সেখানে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। যশোরের সদরের একাংশ, অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলা এবং সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ৫৯০ গ্রামের প্রায় সাত লাখ মানুষ আবারো ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত হবে।
কৃষি জমি জলাবদ্ধ বিল গুলি হলো, বিল কেদারিয়া, বিল গান্ধী মারী, চাতরার বিল, নুনের বিল, বিল ঝিকরা, ধলের বিল,ডুমুরের বিল, শালিখার বিল,ফাহালের বিল, ভায়নার বিল,মাঠের ডাঙার বিল, বিল পায়রা, বিল কপালিয়া,আড়পাতার বিলের ৩০ হাজার হেক্টর জমি ও কেশবপুর উপজেলার বক উড়ার বিল,বাগডাঙার বিল, ভাটবিলার বিল, নড়ের বিল, জিয়লদহের বিল, বিল খুকশিয়া, বিল ভায়নাসহ অনেকগুলি কুড় বিলের ১০ হাজার হেক্টর জমি। বিলগুলি অধিকাংশ মনিরামপুর, অভয়নগর ও কেশবপুর উপজেলার অবস্থিত। উল্লেখ যশোর সদর, মনিরামপুর,অভয়নগর, কেশবপুর ও খুলনা জেলার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার এই ২৭ টি বিল মুক্তেশ্বরী, টেকা,হরি,আপারভদ্রা,হরিহর ও বুড়িভদ্রা নদী দ্বারা বেষ্টিত। এই অঞ্চলের বৃষ্টির ও উজানের পানি উপরে উল্লেখিত নদী ও বিলের সাথে সংযুক্ত খালের মাধ্যমে নিষ্কাশিত হতো। কিন্তু সমুদ্রের লবণাত্মক পানি যাতে জোয়ারের সময় বিলগুলিতে প্রবেশ করতে না পারে এবং কৃষিযোগ্য চাষের পানি ধরে রাখার জন্য ষাটের দশকে অভয়নগরের সীমান্তবর্তী ভবদহ নামক স্থানে হরি ও টেকা নদীর উপরে ২১, ০৯ ও ০৬ ভেন্ট সুইসগেট তৈরি করা হয়। ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত এই সুইজগেটের সুবিধা পাওয়া যায়। মুক্তেশ্বরী- টেকা- হরি-আপারভদ্রা ও বুড়িভদ্রা নদী গুলোর মূল উৎস পদ্মা। এই নদীগুলোর পানির মূল উৎস পদ্মার পানি প্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি হওয়ায় উজানের পানিতে আসা পলি নদী ও খালের তলদেশে পড়ে ভরাট হতে থাকে এবং শুষ্ক মৌসুমে পলির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় খুব দ্রুত সময়ের মধ্য নদীও খালগুলি ভরাট হতে হতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
আর এই জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিত ও কল্পনা প্রসূত কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যার ফলাফল শূন্য। এবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে অলীক সেচ প্রকল্প নিয়ে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএডিসি)। ষাট লক্ষ টাকা খরচ করে ১৩ টি সেচ পাম্পের মাধ্যমে ভবদহ এলাকার ২৭ টি বিলের পানি অপসরণের অপচেষ্টা। এই সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা গেল কিছুদিন চলার পর নদীতে পানি না থাকায় বন্ধ রাখা,পর্যাপ্ত লোকবল,বিদ্যুৎ সরবরাহসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিক‚লতা। ফলাফল ২৭ টি বিলের কয়েকটি বিলের উঁচু জমিতে বোরোধান উৎপন্ন করা গেলেও বাকি ২১ বিলের জল অপসরণ না হওয়ায় স্থায়ীভাবে এখন জলাবদ্ধতায় মগ্ন। বিলগুলির উঁচু অংশের পানি কমলেও অধিকাংশ বিলের জমিগুলিতে কোমর সমান পানি।আর বিলগুলিতে এখন নৌকা চলছে।আর বিলের জমিতে শাপলা-শালুকসহ নানারকম আগাছা জঙ্গলে ভরে আছে। যেহেতু বিলগুলি জলাবদ্ধ তাই আগামী বর্ষাকালে যে আবারও স্থায়ী জলাবদ্ধতার বিভৎস্যরূপ নিবে এই চিন্তায় ভবদহ এলাকার জনগণ চিন্তিত ও শঙ্কিত।
ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রথমে দরকার পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রকল্পের বাইরে রেখে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী দিয়ে নদনদী,খালবিল গুলি খনন,অব্যাহতভাবে নদী ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, পর্যায়ক্রমে ২৭ টি বিলে পরিক্ষিত টিআরএম( টাইডার রিভার্স ম্যানেজমন্ট) চালু রাখা এবং পার্শ্ববর্তী নওয়াপাড়ার ভৈরব নদ খনন করে আমডাঙ্গা খালের সাথে সংযুক্ত করা। অন্যদিকে এই বিলগুলির কিছু বিলে ব্যক্তি মালিকানায় মাছের চাষ হচ্ছে।আর মাছ চাষ করে জমির মালিকদের যত সামান্য টাকা দিয়ে ব্যক্তি বিশেষ লাভবান হচ্ছে।ফলে জোঁক গল্পের ন্যায় এখানেও অত্র এলাকার কৃষকদের রক্ত চোষার ন্যায় শোষণ করা হচ্ছে ।শুধু শোষণ করেই ক্ষান্ত নেই অনেক সময় কৃষকের পাওনা টাকাটাও ঠিক মতো দেয় না।এমনকি চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও ঐসব মালিকেরা তাদের বিলের জমি ছেড়ে দিতে তালবাহানা করে এবং গ্রামের সাধারণ কৃষকদের হুমকি ধামকি দেয়।যা দেখার জন্য স্থানীয় জনপ্রশাসন থাকলেও টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়।অনেক সময় দেখা যায় এই সব মৎস্য ব্যবসায়ীরাও তাদের মাছ চাষের সুবিধার্থে চায় না বিলগুলি জলাবদ্ধতা মুক্ত হোক।আর তাই তারা স্থায়ী সমাধানের জন্য এলাকার সাধারণ মানুষের প্রস্তাবিত সুনির্দিষ্ট কোন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি প্রশাসনকে কব্জা করে নেয়।
যদি কৃষকদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করা যায় এবং সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর থেকে মৎস্য চাষের উপর কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ সরকারি ঋণ দিয়ে মৎস্যচাষে উদ্ধুদ্ধ করা যায় তাহলে সাধারণ কৃষকের কিছু উপকার হতো এবং রক্তচোষাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারতো।
বর্তমানে ভবদহ কপোতাক্ষ নদ সংস্কার কাজ চলমান। কপোতাক্ষের দুপাড়ে এবার ফসলি জমিতে আবাদ হয়েছে। ভবদহ এলাকার অনেক বিল চাষাবাদ করার যোগ্য হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় কপোতাক্ষ ও ভবদহ অঞ্চলের একদল স্বার্থান্বেষী মহল ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বেপরোয়াভাবে ফসলি জমি, খাসজমি ও খাল দখল করে অপরিকল্পিত মাছের ঘের নির্মাণের অপচেষ্টায় লিপ্ত।
এর প্রতিকার চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ভুক্তভোগীরা। সেখানে বলা হয়েছে ইতোমধ্যে কেশবপুরের সোনাতলা বিলের কৃষকগণ ঘের করার প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছেন। কেশবপুরের কাঁদার বিল, বোয়ালিয়া বিল ও সরসকাটি বিলে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। জোরপূর্বক ঘের করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অভয়নগর উপজেলার ঝিকরার বিলে কৃষকরা জমি রক্ষার সংগ্রাম করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘের মালিকরা বল প্রয়োগ, সন্ত্রাসী দিয়ে সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি করছেন। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে না। সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, ভবদহ এলাকার বিলকপালিয়ায় টিআরএম প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ফলে এই জনপদের মানুষের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। শ্রী হরি নদী ড্রেজিং করা কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ সময় এই অঞ্চলের অপরিকল্পিত ঘের অপসারণ, ঘের করার পাঁয়তারা বন্ধ ও দ্রুত প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুন্ন রেখে ঘের-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ণের দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি ঘের নিয়ে কৃষকদের হয়রানি বন্ধ ও কৃষিজমি সুরক্ষার দাবি জানানো হয়।
ভবদহ আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ জানান, সরকার টিআরএম করার প্রস্তুতি নিয়েছে। ইতোমধ্যে ড্রেজিং করা হচ্ছে। কিন্তু ড্রেজিং হচ্ছে অস্বচ্ছ।
ভবদহ আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব চৈতন্য কুমার পাল জানান, সাত উপজেলার সব বিল দখল করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন ঘের মালিকরা। বেশ কিছু ফসলি জমি দখল করে নিয়েছে তারা। জলাবদ্ধতার জন্য এই ঘের মালিকরাই দায়ি।
অভয়নগরের বিল ঝিকরা গ্রামবাসী জানায়, ঘের মালিকরা চলতি বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৪০০ বিঘা জমি দখল করে নিয়েছে। কেউ বাধা দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। তাই দ্রুত বিল কপালিয়ায় টিআরএম চালুসহ বিল, খাল, নদী থেকে বাঁধ অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় ভবদহে আবারও করুণ পরিণতি নেমে আসবে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬১ সালে মণিরামপুরের আড়পাতা, বিল কপালিয়া, অভয়নগর উপজেলার দামুখালি, ভবানিপুর, দত্তগাতি, বারান্দি, চুমড়ডাঙ্গা ও খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কাটেঙ্গা, চেঁচোড়ি, বরুণাসহ ২৭ বিলের পানি নিস্কাশনে সুইস গেট নির্মাণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে ২৭ বিলের আকাশ বৃষ্টির পানি ভবদহের এই সুইস গেট দিয়ে নিষ্কাশিত হয়। ১৯৮৬ সালে সুইস গেটে পলি জমায় পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় এ অঞ্চলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় ভবদহ অঞ্চলের বিলপাড়ের কুলটিয়া, মশিয়াহাটি, মহিষদিয়া, পোড়াডাঙ্গা, সুজাতপুর, ডুমুরতলা, হাটগাছা, সুন্দলীসহ কয়েকশত গ্রামের মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ে। স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে বিলে ফসল না হওয়ায় দেখা দেয় চরম খাদ্য সংকট। তখন পানি নিষ্কাশনে এলাকার ভুক্তভোগীরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেন। এখনো আন্দোলন সংগ্রাম চলছেই।
নদী বন্দর / বিএফ