হারিয়ে যেতে বসা দেশি প্রজাতির মাছ কাকিলা ঝাঁক বেঁধে ছুটবে পুকুরে। ভোজনরসিক বাঙালির পাতেও ফিরবে সুস্বাদু ও দুর্লভ দর্শন মাছটি। কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে তৈরি হয়েছে এমন সম্ভাবনা।
দেশে প্রথমবারের মত কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজননের কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) স্বাদু পানি উপকেন্দ্রে-যশোরের বিজ্ঞানীরা।
উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা জানান, সুচের মতো লম্বাটে এই মাছটি ‘নিডল ফিস’ প্রজাতির। বাংলায় এটি কাকিলা, কাকলে, কাইক্কা, গাংটুরি, কাইলাসহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ নানা কারণে বিলুপ্ত হতে চলেছিল এ জাতের মাছ।
তারা আরও জানান, বিএফআরআই যশোরের স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজননের কলাকৌশল উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন। তিন বছর নিবিড় গবেষণার পর গত ২৫ আগস্ট প্রজননকৃত মাছের ডিম থেকে পোনা বের হওয়ার মধ্য দিয়ে সফলতা পান তারা। দেশে বিলুপ্তপ্রায় মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতার তালিকায় ৩১তম মাছ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় নাম ওঠালো এটি। এখন এই মাছ চাষ সম্ভব হবে পুকুর বা বদ্ধ জলাশয়ে। আবার পানিতে ঢেউ তুলবে কাকিলা, এমনই প্রত্যাশা বিজ্ঞানীদের।
জানা যায়, একটা সময় ছিল যখন প্রাকৃতিক জলাশয়ে কাকিলা মাছ মিলতো প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাছটির। ফলে প্রাচুর্যতাও কমে গেছে ব্যাপক হারে। নদী, খাল-বিল, বাওড়ের মতো জলাধারগুলোয় এই মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। কিন্তু বদ্ধ পরিবেশে অভ্যস্ত করে ও কৃত্রিম প্রজনন কলাকৌশল উদ্ভাবন হওয়ায় মাছটির হারানো প্রাচুর্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
জানা যায়, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী কাকিলা মাছে ১৭.১ শতাংশ প্রোটিন, লিপিড ২.২৩ শতাংশ, ফসফরাস ২.১৪ শতাংশ ও ০.৯৪ শতাংশ ক্যালিসিয়াম রয়েছে। যা অন্যান্য ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি।
কাকিলার প্রজনন উদ্ভাবনে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানান, মাছটির প্রজননের জন্য পিজি (পিটুইটারি গ্ল্যান্ড) হরমোন ব্যবহার করা হয়। গত ১৮ আগস্ট পুকুর থেকে মাছ ধরে চার জোড়া বাবা এবং মা মাছ নির্বাচন করে হ্যাচারির চৌবাচ্চায় রাখা হয়। সেখানে নির্দিষ্ট সময় ধরে ঝর্ণাধারায় রেখে সেগুলোকে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট একটি মাত্রার হরমোন ইনজেকশন। পরে মা-বাবা মাছকে একসাথে একটি চৌবাচ্চায় রেখে ঝর্ণাধারা দিয়ে সেখানে কচুরিপানা রাখা হয়। এর প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর মা মাছ ডিম ছাড়ে। ডিমের ভেতরে বাচ্চার বিভিন্ন দশা ও উন্নয়ন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ডিম ছাড়ার প্রায় ৯০ থেকে ১০০ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়।
এ বিষয়ে শরীফুল ইসলাম জানান, পদ্মা নদী থেকে কাকিলার (মা-বাবা মাছ) মাছ সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে যশোরে আনা হয়। এরপর সেগুলো যশোরের স্বাদু পানি উপ-কেন্দ্রের পুকুরে ছাড়া হয়। আর সেগুলোকে খাওয়ানো হয় হ্যাচারিতে উৎপাদিত কার্প জাতীয় মাছের জীবিত পোনা ও নানা জলাশয় থেকে সংগৃহীত জীবিত ছোট মাছ। এভাবে পুকুরের আবদ্ধ পরিবেশে অভ্যস্ত করা হয় কাকিলা ব্রæডগুলোকে। এর পরে চলতি বছরের মে মাস থেকে কৃত্রিম প্রজননের উদ্দেশ্যে উপ-কেন্দ্রের হ্যাচারিতে বৈজ্ঞানিক প্রটোকল মেনে নির্দিষ্ট সংখ্যক মা-বাবা মাছকে প্রয়োগ করা হয় বিভিন্ন ডোজের হরমোন ইনজেকশন। এভাবে কয়েকবার বিভিন্ন ডোজের ট্রায়াল দেয়া হলেও মাছের প্রজনন সফলতা আসেনি। কিন্তু অবশেষে ২৫ আগস্ট প্রজননকৃত মাছের ডিম থেকে পোনা বের হয়। ফলে কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা আসে।
গবেষক দলের প্রধান ও বিএফআরআই যশোর স্বাদু পানির উপকেন্দ্রের প্রধান ড. রবিউল আউয়াল হোসেন জানান, কাকিলার দেহ লম্বা ও সামান্য চাপা। মাছটি প্রায় সিলিন্ডার আকৃতির। এগুলো লম্বায় ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার হয়। পরিণত পুরুষ মাছের মাথার শীর্ষে লাল চূঁড়া দেখতে পাওয়া যায়। আর যার জন্য স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সহজেই আলাদা করা যায়।
তিনি আরও জানান, পুরুষ মাছের দেহ স্ত্রী মাছের তুলনায় অধিক সরু ও আকারে একটু ছোট হয়। এটি শিকারি মাছ। মূলত ছোটমাছ খেয়ে থাকে। প্রাকৃতিক ও প্রবাহমান জলাশয়ে বিশেষ করে নদীতে ও বর্ষাকালে প্লাবিত অঞ্চলে এই মাছ প্রজনন করে। পরিণত মাছেরা ভাসমান জলজ উদ্ভিদ নেই এমন স্থানে বসবাস করলেও জলজ উদ্ভিদের পাতার নিচে ও ভাসমান শেকড়ে এদের স্ত্রীরা ডিম পাড়ে। কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন বাংলাদেশ এই প্রথম। বিশ্বের কোথাও এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
নদী বন্দর / এমকে