সুদের পরিবর্তে মুনাফাভিত্তিক কারবারে বেশি আগ্রহী হওয়ায় দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দ্রুত বিকাশ ঘটছে। মানুষের আগ্রহের ফলে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোও ইসলামী ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকছে। গত বছরও প্রচলিত ধারার দুটি ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়েছে। আরো কয়েকটি ব্যাংক রূপান্তরের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রচলিত ধারার অন্য ব্যাংকগুলো ইসলামী ব্যাংকিং শাখা খোলার প্রতি জোর দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় ২৭ শতাংশই ইসলামী ব্যাংকগুলোর দখলে। এ ছাড়া বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় সাড়ে ২৭ শতাংশের বেশি এ খাতের ব্যাংকগুলোর। প্রবাস আয়ের প্রায় ৩৮ শতাংশ আসছে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্মভীরু। তারা সুদভিত্তিক কারবারের পরিবর্তে শরিয়াহভিত্তিক কারবারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারণ ইসলামী ব্যাংকগুলো মুদারাবা পদ্ধতিতে আমানত সংগ্রহ করে। আমানতের এই অর্থ বিভিন্ন শরিয়াহ অনুমোদিত পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে থাকে। আবার এ থেকে অর্জিত মুনাফা আমানতগ্রহীতা ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। ফলে এ ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। তবে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনায় দেশে এখনো পৃথক আইন হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক নীতিমালার আওতায় ইসলামী ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে।
বর্তমানে দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০টিতে উন্নীত হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ছাড়া বাকি ৯ ব্যাংক হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ও গ্লোবাল ইসলামী গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইসলামী ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে। আর ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক, যাদের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, গত জুন পর্যন্ত দেশে মোট ১০ হাজার ৭৮৮টি ব্যাংক শাখার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডোর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮০২। এর মধ্যে এক হাজার ৫৬৯টি শাখাই পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর। বাকি ৩৯টি ইসলামী শাখা রয়েছে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর। এর বাইরে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর আরো ১৯৪টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো খুলে সেবা দিচ্ছে।
বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের এমডি মো. মুনিরুল মওলা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মানুষের প্রয়োজন সামনে রেখে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালিত হয়। একজন ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী যে পেশায় থাকেন, তাঁর কী প্রয়োজন সেটা এখানে বিবেচনা করা হয়। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে কোনো টাকার কারবার হয় না, পণ্যের কারবার হয়। ফলে যাঁরা রিয়েল ইকোনমিকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চান, তাঁদের জন্য ইসলামী ব্যাংকিং সবচেয়ে বেশি উপযোগী। ইসলাম ধর্মে সুদকে হারাম বা নিরুৎসাহ করা হয়েছে। ফলে ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকেও ইসলামী ব্যাংকিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি।’
গত বছর প্রচলিত ধারার ব্যাংক থেকে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হওয়া স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি খন্দকার রাশেদ মাকসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকিংয়ে রূপান্তরের পর আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
প্রচুর নতুন গ্রাহক পেয়েছি। এ ছাড়া আগের যারা গ্রাহক ছিল, তাদের প্রায় সবাই আমাদের সঙ্গে রয়ে গেছে। সব মিলে আমাদের সাত লাখের কাছাকাছি গ্রাহক। আর এটাই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।’ তিনি আরো বলেন, প্রতিবছরই ইসলামী ব্যাংকিং বাড়ছে। এটা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। মূলত ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকেই মানুষ ইসলামী ব্যাংকিংয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছে বলে জানান তিনি।
চতুর্থ প্রজন্মের প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোও ইসলামী ব্যাংকিং শাখা খোলায় জোর দিয়েছে। বেসরকারি সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের এমডি মো. মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই আমরা ১০টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা খুলেছি। কিন্তু এসব শাখায় ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। এর মানে দেশের মানুষ সুদভিত্তিক কারবারের চেয়ে মুনাফাভিত্তিক কারবারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকিংয়ে সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি। এটা যেমন ব্যাংকের জন্য, তেমনি গ্রাহকেরও। সব মিলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা দেশে বেশ উজ্জ্বল।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে রয়েছে তিন লাখ ৬৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের ২৭.২৬ শতাংশই ইসলামী ব্যাংকগুলোর। গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের আমানতের ২৫.৩৩ শতাংশ ছিল ইসলামী ব্যাংকগুলোর। অন্যদিকে গত জুন শেষে ব্যাংক খাতের ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৯০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা।
এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ঋণের অংশ ছিল তিন লাখ ২৭ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা বা ২৭.৫৫ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকগুলোর ঋণের অংশ ছিল দুই লাখ ৯৪ হাজার ৯৩ কোটি টাকা বা ৪০.৫১ শতাংশ। গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে আসা মোট প্রবাস আয়ের পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা।
এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আসে ২০ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট প্রবাস আয়ের ৩৮.২৪ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে আসা মোট প্রবাস আয়ের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অংশ ছিল প্রায় ২১ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা বা ৪০.৫১ শতাংশ।
ইসলামী ব্যাংকিংয়ে বাজার বড় হওয়ার সঙ্গে এ খাতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে। গত জুন পর্যন্ত এ খাতে জনবল বেড়ে হয়েছে ৪৩ হাজার ৯০৯ জন। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে জনবল রয়েছে ৪২ হাজার ৯৭৪ জন। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জনবলের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৭৮৪ জন, যার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ছিল ৩৭ হাজার ৮১০ জন।
জানা যায়, বর্তমানে প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৫ টাকা ঋণ দিতে পারে। ইসলামী ব্যাংকগুলো সেখানে ৯০ টাকা দিতে পারে। অথচ প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ১৩ শতাংশ এসএলআর রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য তা সাড়ে ৫ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলো যেকোনো সময় আমানতে মুনাফার হার পরিবর্তন করতে পারলেও প্রচলিত ধারার ব্যাংক তা পারে না। এতে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের তুলনায় ইসলামী ব্যাংকের ভালো মুনাফা করার সুযোগ তৈরি হয়। ফলে অনেক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিংয়ে রূপান্তরে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এতে দিন দিন ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পরিধিও বাড়ছে।
নদী বন্দর / সিএফ