বেল আমাদের দেশের বেশ পরিচিত একটি ফল। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এ ফল পাওয়া যায়। তবে এর চাষ আমাদের দেশে এখনও বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা হচ্ছে না। বেল একটি পুষ্টিকর আর উপকারী ফল। কাঁচা-পাকা দুটিই সমান উপকারী।
কাঁচা বেল ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগের জন্য ভীষণ উপকারী। পাকা বেলের শরবত সুস্বাদু। বেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, এ এবং ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাসিয়ামের মতো দরকারী পুষ্টি উপাদান।
বেল চাষ করার জন্য আলাদা কোনো কিছু করার দরকার পড়ে না। অন্য ফলদ গাছ যেমন, আম, জাম, লিচু আর কাঁঠালেরমতো সাধারণ পরিচর্যাতেই এগুলো বড় হয়ে থাকে।
শীতকালে বেল গাছের সব পাতা ঝরে যায়, আবার বসন্তে নতুন পাতা গজায়। বেল ফল দেখতে সাধারণত গোলাকার শক্ত খোসাবিশিষ্ট। কাঁচা ফলের রং সবুজ, পাকলে বেল হলদে হয়ে যায়। ভেতরের শাঁসের রং হয়ে যায় কমলা বা হলুদ। পাকা বেল থেকে সুগন্ধ বের হয়।
বীজ থেকে একটি বেলগাছ হতে এবং তা থেকে ফলন পেতে সময় লাগে প্রায় ১৫ বছর যা এদেশে চাষাবাদযোগ্য যেকোনো ফলের তুলনায় বেশি। ফল পাওয়ার জন্য এত দীর্ঘ সময় কেউ অপেক্ষা করতে চায় না ফলে বেলের চাষাবাদ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
আমাদের বাড়ির আশেপাশে যে দুয়েকটি গাছ চোখে পড়ে তা আসলে বীজ থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো। তবে মূলের কাটিং করে, এয়ার লেয়ারিং এবং ক্লেফট গ্রাফটিং বা ফাটল কলমের মাধ্যমে বেলের বংশবিস্তার করা যায়।
গবেষণার ফলাফল হতে দেখা গেছে কলমের গাছ থেকে মাত্র ৪ থেকে ৬ বছরেরই বেল সংগ্রহ করা সম্ভব। সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রায় ১০ বছর আগেই কলমের গাছ থেকে বেল সংগ্রহ করা সম্ভব। অনেকের এ সম্পর্কে ধারণা নেই। তারা মনে করেন বেলের অঙ্গজ বংশবিস্তার হয় না। বর্তমানে এদেশে বেলের উদ্ভাবিত কোনো জাত নেই। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ভালো জাতের বেল।
বর্তমানে দেশে ৫০০ গ্রাম হতে শুরু করে ২০ কেজি ওজনের বেল জন্মাতে দেখা যায়। সুতরাং একজন ইচ্ছে করলে খুব সহজেই যেকোনো ওজনের বেলের বাগান করতে পারবেন।
এর জন্য প্রথম কাজটি হবে গুণগত মানসম্পন্ন মাতৃগাছ নির্বাচন করা যা থেকে পরবর্তীতে সায়ন সংগ্রহ করা যাবে। দ্বিতীয় কাজটি হলো যেকোনো বেলের বীজ হতে পলিব্যাগে চারা উৎপাদন করা যা পরে রুটস্টক হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং শেষ কাজটি হলো উপযুক্ত সময়ে (এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি) প্রত্যাশি বয়সের (৩ থেকে ৬ মাস) রুটস্টকে প্রত্যাশিত সায়নটি ক্লেফট গ্রাফটিং বা ফাটল কলমের মাধ্যমে জোড়া লাগানো।
আসলে অন্যান্য ফলের বেলায় যেভাবে ক্লেফট গ্রাফটিং বা ফাটল কলম করা হয়, বেলের ক্ষেত্রে একইভাবে করা হয় তবে এক্ষেত্রে সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানভেদে সময় ৭ দিন কম বেশি হতে পারে।
সেক্ষেত্রে মাতৃগাছের নতুন কচিপাতা বের হওয়ার আগেই ডগা সংগ্রহ করে কলম বাঁধার কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। মাতৃগাছে কচিপাতা বের হওয়ার পর কলম করলে কলমের সফলতা অনেক কমে যাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ ভাগে নেমে আসতে পারে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে কলম করা হলে সফলতা প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ।
গ্রাফটিং করার দুই সপ্তাহের মধ্যেই নতুন কুশি বের হবে। তবে কলম করার সপ্তাহখানেক পর হতে দিনে অন্তত একবার করে দেখাশোনা করতে হবে। সায়ন হতে নতুন কুশি বের হলে উপরের পলিথিন কভারটি সরিয়ে ফেলতে হবে এবং রুটস্টক হতে কোনো কুশি বের হলে তা ভেঙে ফেলতে হবে। লাইন-লাইন এবং গাছ-গাছের দূরত্ব ৬ থেকে ৮ মিটার হতে হবে। সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ৫০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ, প্রস্থ ও গভীরতায় গর্ত করতে হবে।
গর্ত করার সময় গর্তের উপরের অর্ধেক অংশের মাটি একপাশে এবং নিচের অংশের মাটি অন্যপাশে রাখতে হবে। গর্ত থেকে মাটি উঠানোর ১০ দিন পর্যন্ত গর্তটিকে রোদে শুকাতে হয়। এরপর প্রতি গর্তে ১০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম টিএসটি, ২০০ গ্রাম এমপি, ১৫০ গ্রাম জিপসাম, ৫০ গাম জিংক সালফেট এবং ১০ গ্রাম বোরিক এসিড উপরের অংশের মাটির সাথে মিশিয়ে মাটি উলট-পালট করে গর্ত ভরাট করতে হবে।
গর্ত ভরাটের সময় উপরের অর্ধেক অংশের মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট না হলে প্রয়োজনে চারপাশ থেকে উপরের মাটি গর্তে দিতে হবে। গর্তের নিচের অংশের মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট না করাই ভালো। কলমের এই চারাটি জুন-জুলাই মাসে নির্ধারিত গর্তে রোপণ করতে হবে। রোপণের পর চারাটি সোজা করে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে এবং বৃষ্টি না হলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। উপরোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে খুব সহজেই লাভজনকভাবে বেলের বাগান করা সম্ভব।
বর্তমানে বেলের চাষাবাদ নেই বললেই চলে। প্রতিনিয়ত এই গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় কোনো কোনো সময় বেল বাজারে খুঁজেই পাওয়া যায় না। ফলটির বাজারমূল্যেও কম নয়।
ছোট আকারের একটি বেলের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা। আর বড় আকারের বেলের দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বাণিজ্যিক ও পরিকল্পিতভাবে বেলের বাগান করলে বর্তমানে অবশ্যই চাষি লাভবান হবেন। ভেষজ গুণের কথা চিন্তা করে হলেও বেলের চাষ করা উচিত।
নদী বন্দর / জিকে