ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
তিনি বলেছেন, সরকার বিগত এক যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশের চার স্তম্ভ- কানেক্টিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্মেন্ট এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশন ঘিরে নেওয়া অধিকাংশ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। ফলে দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইড কমে আসছে।
বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিশ্ব সম্মেলনের ২৫তম আসর ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন ইনফরমেশন টেকনোলজি ‘ডব্লিওসিআইটি ২০২১’ এবং ‘অ্যাসোসিও ডিজিটাল সামিট ২০২১’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ অনুষ্ঠান চলবে চারদিন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম কমানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল যন্ত্র হাতের নাগালে আনার পাশাপাশি মানুষের হাতের মুঠোয় সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। জনগণ এখন ঘরে বসেই দুই শতাধিক নাগরিক সেবা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০২১ সাল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অনন্য ও স্মরণীয় বছর। এ বছর আমরা একই সঙ্গে উদযাপন করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ বছরই পূরণ হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার। এমনই এক শুভক্ষণে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অন ইনফরমেশন টেকনোলজির ২৫তম আসর। প্রিয় দেশবাসী, দেশের বাইরের সব প্রবাসী ও বিদেশি বন্ধুদের এ শুভক্ষণে আমি উষ্ণ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ২০২১ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বিশ্ব সম্মেলনের ২৫তম আসর ‘ডব্লিওসিআইটি ২০২১’র আয়োজক বাংলাদেশ। এটা আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়। এ আয়োজন অবশ্যই বাংলাদেশে আইসিটি খাতের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ‘আইসিটি দ্য গ্রেট ইকুয়ালাইজার’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে যথার্থ হয়েছে বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, দূরদর্শী চিন্তা থেকেই বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান গবেষণা এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ভিত্তি রচনা করেছিলেন। তারই উদ্যোগে ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ আইটিইউর সদস্যপদ লাভ করে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) প্রখ্যাত বিজ্ঞানী কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। এ কমিশনের সুপারিশে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় বিজ্ঞান গবেষণা, উদ্ভাবন ও কারিগরি বিদ্যাকে। ১৯৭৩ সালেই বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন তিনি বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট আর্থ-স্টেশনের উদ্বোধন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতে পথচলা থেমে যায়। দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি মোবাইল ফোনের মনোপলি ভেঙে তা মানুষের কাছে সহজলভ্য করেন।
তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। ২০০৯ সালে দেশের মাত্র ৮ লাখ মানুষ ইন্টারনেট সেবা পেতো। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১২ কোটির বেশি। এ সময়ে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে চারগুণের বেশি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার প্রমাণ আমরা পাই করোনা মহামারির দুঃসময়ে। মহামারি মোকাবিলায় সবচেয়ে নির্ভরশীল মাধ্যম হয়ে ওঠে তথ্যপ্রযুক্তি। দেশের শিক্ষা কার্যক্রম, বিচারিক কার্যক্রম, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকিংসেবা হয়ে পড়ে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর। কোভিড-১৯ মহামারিকালে তথ্যপ্রযুক্তির স্থানীয় বাজার অকল্পনীয় প্রসার লাভ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেই দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রাখা হয়। আইসিটি বিভাগ কোনো রকম অর্থ ব্যয় ছাড়াই ‘সুরক্ষা’ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে করোনার টিকা কার্যক্রমকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনায় সহযোগিতা করছে। এ প্লাটফর্মে নিবন্ধনের সংখ্যা এরই মধ্যে ৭ কোটি ছাড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দেশে গড়ে উঠছে ডিজিটাল অর্থনীতি। আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের তৈরি সফটওয়্যার ও আইটিসেবা সরবরাহ হচ্ছে। আইটি খাতে রপ্তানি ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এ আয় ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে এবং জিডিপিতে সফটওয়্যার ও আইসিটি সেবাখাতের অবদান ৫ শতাংশে উন্নীত হবে। এ লক্ষ্যে দেশজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ৩৯টি হাইটেক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এবং আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার।
আবদুল হামিদ বলেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যার দিক থেকে সারাবিশ্বে আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে সাড়ে ৬ লাখ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। তাদের পেশাগত উন্নয়নে আইডি কার্ড দেওয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ফলে আমাদের সামনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এজন্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রগামী প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। এ বিশাল যুব সম্প্রদায়কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তা ও পেশাজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি একদিকে যেমন আমাদের জন্য অবারিত সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এর অপব্যবহার ও জালিয়াতির কারণে অনেক চ্যালেঞ্জেরও জন্ম দিয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির বিনিময় ও হস্তান্তর বিশ্বব্যাপী উন্নয়নে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবন বা আমদানিই যথেষ্ট নয় বরং এর টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
‘সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা টেকসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন, প্রসার এবং ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রিয় মাতৃভূমিকে একটি উন্নয়নশীল দেশের মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো, ইনআল্লাহ’- যোগ করেন তিনি।
নদী বন্দর / জিকে