ইউক্রেন সংকটের কারণে রাশিয়া যেকোনো সময় ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। আর সে কারণে রাশিয়ার বিকল্প খুঁজতে মরিয়া ইউরোপের দেশগুলো। সম্প্রতি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবিতে ধরা পড়ে যে, ইউরোপের সমুদ্রপথে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) কনটেইনার ভর্তি জাহাজের ভিড় বেড়ে গেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে এলএনজি আমদানির পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপ মহাদেশের সামুদ্রিক ঘাটে জ্বালানিবাহী জাহাজের সংখ্যা গতবছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে।
ইউক্রেন ইস্যুতে হুমকি-পাল্টা হুমকি দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। এই উত্তেজনার মুহূর্তে ইউক্রেনকে তার ন্যাটো মিত্রদের থেকে বিভাজিত করতে ক্রেমলিনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র কী হতে পারে তা নিয়ে চলছে আলোচনা। বিশ্লেষকদের ধারণা প্রাকৃতিক গ্যাসকেই এক্ষেত্রে বড় অস্ত্র বানাতে পারে মস্কো। কারণ রাশিয়ার গ্যাসলাইন ইউক্রেনের ওপর দিয়েই ইউরোপে গেছে।
স্যাটেলাইটের ছবি ও ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, চলতি মাসে প্রতিদিন গড়ে ৪০টির মতো এলএনজি বহনকারী জাহাজ উত্তর সাগর, বাল্টিক ও ভূমধ্যসাগর এবং ফ্রান্সের পশ্চিম উপকূল বরাবর সমুদ্রপথে অবস্থান করছে। গতবছরের জানুয়ারি থেকে এ সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। এর আগে একই সময় ২৪টি জাহাজের অবস্থান শনাক্ত হয়েছিল। বর্তমানে সেই জাহাজের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৫০টি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ থেকে যাওয়া এসব এলএনজি লোড করা জাহাজের কারণে নৌপথে যানজটেরও সৃষ্টি হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী মাসে রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন এরই মধ্যে। রাশিয়ার প্রায় এক লাখ সৈন্য অবস্থান করছে ইউক্রেন সীমান্তে।
বিশ্বের প্রাকৃতিক গ্যাসের ১৭ শতাংশ উৎপাদন করে রাশিয়া। আর এই গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ইউরোপীয় দেশগুলো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য বলছে, ১৯৭০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউরোপ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি শুরু করে। সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে সেই নির্ভরতা আরও বেড়েছে। বছরে এখন ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরোপে সরবরাহ করে রাশিয়া। কিন্তু রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে প্রায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ করে আসছে। ফলে অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে প্রায় ছয় বা সাত গুণ বেড়েছে।
গ্যাস সংকটের ইস্যুটি নিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন দের ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এতে ইউক্রেন সংকটের পাশাপাশি, ইউরোপে জ্বালানি নিরাপত্তাবিষয়টির প্রতিও গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে রাশিয়ার বিকল্প জ্বালানি গ্যাসের সন্ধানে উৎস খুজতে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বড় পরিসরে এলএনজি সরবরাহ বাড়িয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে।
স্বল্প-মেয়াদে এলএনজি সরবরাহের নিরাপত্তা বাড়াতে ইউরোপীয় কমিশন এলএনজি টার্মিনালগুলোর স্বচ্ছতা এবং ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেবে বলেও জানান তারা।
এশিয়ায়, বিশেষ করে জাপান, আরেকটি বড় এলএনজি আমদানিকারক। তারাও উদ্বিগ্ন যে ইউরোপের দুর্দশা তাদের নিজের ওপরেও পড়তে পারে।
২০২০ সালের নভেম্বরে ১১০টিরও বেশি জাহাজ এশিয়ার জলসীমায় এলএনজি বহন করেছিল। একই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ২০টিরও বেশি জাহাজ ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের নৌ রুটে যাত্রা করে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ইউরোপে বেড়েছে গ্যাসের দামও। গত বুধবার পর্যন্ত গ্যাসের দাম গত বছরের থেকে ৪ দশমিক ৬ গুণ বেড়ে ঘণ্টা প্রতি মেগাওয়াট একশ মার্কিন ডলারের বেশি হয়েছে। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি বিপাকে জার্মানি। দেশটি রাশিয়া থেকে ৬০ শতাংশ গ্যাস আমদানি করে।
আবার এই তরলীকৃত গ্যাস সংরক্ষণ নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছে। জাপানের একজন গবেষক বলেন, এরই মধ্যে সংরক্ষণের জন্য যে ব্যবস্থা তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এদিকে, ২০২১ সালের তুলনায় ইউরোপ চলতি সপ্তাহে এলএনজি আমদানির পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়িয়েছে।
রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহের জন্য ‘নর্ড স্ট্রিম-টু’ পাইপলাইন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে রাশিয়া থেকে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করার কথা রয়েছে। ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে যাওয়া গ্যাস পাইপলাইনটি এক হাজার ২২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। যা নির্মাণে সময় লেগেছে পাঁচ বছর, ব্যয় হয়েছে ১১০০ কোটি মার্কিন ডলার। তবে লাইনটি দিয়ে এখনো গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়নি। জার্মানির সরকারের এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে তাদের অনেক মিত্র দেশ। তারা বলছে, এটি রাশিয়ার ওপর জার্মানির নির্ভরতাকে আরও গভীর করবে।
বর্তমান সংকট এড়াতে প্রাকৃতিক গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ এলএনজি রপ্তানি বাড়িয়েছে।
জানা গেছে, আগামী সোমবার (৩১ জানুয়ারি) কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানিকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেখানে ইউরোপে কাতারের প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে। রিম ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, কিন্তু কাতার দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস সরবরাহ চুক্তি করেছে এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। ফলে তাদের অতিরিক্ত রপ্তানির জন্য আপাতত জায়গা খালি নেই।
সূত্র: নিক্কেই এশিয়া
নদী বন্দর / বিএফ