‘কুয়াকাটায় এখন যেখানে সমুদ্র, সেটি ছিল আরও দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। বেড়িবাঁধ থেকে হেঁটে সৈকতে পৌঁছাতে সময় লাগত ১৫ থেকে ২০ মিনিট। মাঝের জায়গাটিতে মাটির রাস্তার দুধারে ছিল নারিকেল বাগান আর জঙ্গল। অথচ আজ উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে বাঁধে। চলছে বেড়িবাঁধ রক্ষার চেষ্টা। মাত্র ২০-২২ বছরে সাগর এতটা পথ এগিয়ে এসেছে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে আসছে বর্ষায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে সাগর ঢুকে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’
হতাশার সুরে কথাগুলো বলছিলেন কুয়াকাটার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব সোহরাব হোসেন। শুধু সোহরাবই নন, সমুদ্রের উন্মত্ত ঢেউ ভয় জাগাচ্ছে কুয়াকাটার সবার মনে। বিশেষ করে পর্যটনকেন্দ্রিক বাণিজ্যে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
আবাসিক হোটেলের মালিক সোহেল আহম্মেদ বলেন, ‘এখানে কিন্তু সাগর ভাঙে না, ঢেউ এসে ধুয়ে নিয়ে যায় তীর। এভাবে ধুয়ে নিতে নিতে এগিয়ে আসে সমুদ্র। ১০-১২ বছর আগে যখন এখানে এসে ব্যবসা শুরু করি তখন সমুদ্র ছিল অনেক দূরে। মাত্র ক’টা বছরের ব্যবধানে সেই সমুদ্র এখন ঘরের দরজায়।’
তিনি বলেন, সৈকতের পশ্চিমপ্রান্তে নতুন বেঁড়িবাধ ‘রিং বাঁধ’ করেও সামাল দেওয়া যায়নি কিছুই। সবই গিলে খেয়েছে সমুদ্র। পশ্চিমের কিছু অংশে বেড়িবাঁধের বাইরে বসানো হয়েছিল কংক্রিটের ব্লক। সেগুলোতেও আঘাত হানছে ঢেউ। আগে জোয়ারের সময়ও হেঁটে ঘুরে দেখা যেত ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত। এখন ভাটিতেও অনেক জায়গা ডুবে থাকে পানির নিচে।’
স্থানীয় উদ্যোক্তা খলিল শরীফ বলেন, ‘একটা সময় বরিশাল থেকে কুয়াকাটা আসতে পথে ছিল ছয়টি ফেরি। সেসব জায়গায় ব্রিজ হয়ে গেছে। ভালো হয়েছে রাস্তা-ঘাট। ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে পর্যটক। জুনের শেষ নাগাদ পদ্মা সেতু চালু হলে আরও কয়েকগুণ বাড়বে এই ভিড়। কেননা তখন রাজধানী ঢাকা থেকে সবচেয়ে কাছের সমুদ্র সৈকত হবে কুয়াকাটা। দিন দিন যেখানে সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে এ সৈকত সেখানে আমরা সন্দিহান এর অস্তিত্ব টিকে থাকা নিয়ে।’
বছরের পর বছর ধরে এভাবে সমুদ্র এগোলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ কুয়াকাটার মানুষ। কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টের সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, ‘বহু বছর ধরেই একটু একটু করে মাটি ধুয়ে জনপদের দিকে এগোচ্ছে সাগর। ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে বেড়ে যায় এর তীব্রতা। গেল ২০-২২ বছরে সাগর এগিয়েছে কম করে হলেও তিন কিলোমিটার।
ব্যক্তিমালিকানাধীন অগণিত স্থাপনার পাশাপাশি বিলীন হয়েছে কুয়াকাটা ইকো পার্কের বিশাল একটি অংশ, ঝাউবন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি সাইক্লোন সেন্টার, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্ট, সরকারি জমি লিজ নিয়ে গড়ে ওঠা ফয়েজ মিয়ার বিশাল নারিকেল বাগানসহ আরও অনেক কিছু।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে আসন্ন বর্ষায় সাগর পাড়ে বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা হোটেল, মার্কেট এবং শুঁটকি বাজারসহ অন্তত হাজারখানেক স্থাপনা বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের আগে সাগরের এই ধুয়ে নেওয়া ঠেকাতে বালুর বস্তা ফেলাসহ কিছু কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু বালুর বাঁধ দিয়ে যে সাগর ঠেকানো যায় না তা তাদের কে বোঝাবে?’
কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শফিকুর রহমান চান বলেন, ‘সরকারের এমন কোনো মন্ত্রণালয় আর দপ্তর নেই যেখানে যোগাযোগ করিনি আমরা। এখানে পায়রা সমুদ্রবন্দর হয়েছে, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে।
পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে। সব মিলিয়ে ক্রমেই বাড়ছে সৈকতের সম্ভাবনা। বড় বড় ব্যবসায়ী এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন। ২২ বছর আগে যখন পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে শুরু করল তখনই কেন ব্যবস্থা নেয়া হলো না। মাঝে এত দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পরও কেন আমাদের এখনো একই ভয়ে ভীত থাকতে হচ্ছে?’
জানা গেছে, এখানে সাগরের এগিয়ে আসা ঠেকানো এবং সাগর পারে নান্দনিকতা গড়ে তুলতে প্রথম প্রকল্প প্রস্তাব দাখিল করা হয় ২০১৮ সালে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে পাঠানো ওই প্রস্তাবে ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়ক স্থাপনসহ বেশ কিছু উন্নয়ন কাজের কথা বলা হয়।
পরিকল্পনা কমিশনে যাওয়ার পর সেই প্রস্তাবনা ফেরত পাঠায় তারা। পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাঠাতে বলা হয় নতুন প্রস্তাব। পরে গত বছরের অক্টোবরে আবারো ৯৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। এবারও ত্রুটির কথা উল্লেখ করে ফেরত পাঠায় কমিশন। বলা হয়, নতুন করে প্রস্তাব জমা দিতে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে তখন ফেরত এসেছিল ওই প্রকল্প। নিয়ম অনুযায়ী, ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের কোনো প্রকল্প হলে সম্ভাব্যতা যাচাই করে নিতে হয়। চার বছর আগে পাঠানো প্রকল্পটির ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
গত বছরের অক্টোবরে আমরা যে ৯৫৬ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাই তা তৈরি করা হয়েছে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং ফিজিবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী। তারা সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে রিপোর্ট দেওয়ার পর তৈরি হয় সেটি।
পরিকল্পনা কমিশনে যাওয়ার পর তারা আরও কিছু সংযোজন বিয়োজনের সুপারিশ করে। সে অনুযায়ী দু’বার সংযোজন বিয়োজনের পর সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে আমরা এক হাজার ২১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছি। যতদূর জানি মার্চের ২২ তারিখে সেটি পরিকল্পনা কমিশনে জমা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো এই অর্থবছরের মধ্যে এটির প্রি-একনেক হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, মেরিন ড্রাইভ, বনায়ন, লাইফ গার্ড স্টেশন, পাবলিক টয়লেট, অটেমোটেভ লকার এবং ছোট একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ আরও অনেক কিছু রয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে কুয়াকাটা হবে আন্তর্জাতিক মানের একটি সমুদ্রসৈকত।
নদী বন্দর/এসএম