সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত এলাকা থেকে ধীর গতিতে পানি নামছে। উন্নতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির। তবে মধ্যাঞ্চলে বন্যার পানি বাড়ছে। এতে ছয় জেলায় বন্যার অবনতি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ অথবা শেষ সপ্তাহে যমুনা অববাহিকায় বড় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু তাই নয়, আগামী সেপ্টেম্বর অব্দি বর্ষাকাল জুড়ে বন্যা হতে পারে। অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্তও স্থায়ী হতে পরে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণাধীন ১০৯টি নদীর মধ্যে পদ্মা-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, ধরলা, কুশিয়ারা, তিতাস ও দুধকুমারসহ ৯টি প্রধান নদনদীর পানি ১৮টি পয়েন্টে বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আবহাওয়া সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৩৬ ঘণ্টায় দেশের অভ্যন্তরে ও উজানের বিভিন্ন অংশে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির আশঙ্কা কম।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া গতকাল বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া ও জামালপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে। একই সময়ে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
পাউবোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চারটি, যমুনার পানি পাঁচটি, সুরমার তিনটি এবং কুশিয়ারা নদীর দুটি স্থানে পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি কমতে পারে। এ সময়ে ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি স্থিতিশীল থাকতে পারে। একই সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, এই বন্যা শেষ নয়, জুলাইয়ের দ্বিতীয় বা শেষ সপ্তাহেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরেকটি বড় বন্যার ঝুঁকি আছে। মৌসুমি বায়ু সারা দেশে বিস্তার লাভ করেছে। সামনে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা যমুনা অববাহিকা ধরে উত্তরবঙ্গে বিস্তার লাভ করতে পারে।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পূর্বাংশে লা-নিনা অবস্থান করায় এই বর্ষায় আরো বন্যার আশঙ্কা আছে। লা নিনা অবস্থান করলে সে বছর ভারতীয় উপমহাদেশে গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় এবং গড় বন্যা পরিস্থিতির তুলনায় বেশি এলাকা প্লাবিত হয়। জুলাইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে দেশে ব্যাপক বন্যার আশঙ্কা আছে।
তিনি বন্যা পূর্বাভাসের নানা তথ্য উপাত্ত ও বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি প্রবাহের গতি প্রকৃতির বিশ্লেষণ বলেন, চিলমারী থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত যমুনার পানিপ্রবাহ বিপদ সংকেত দিতে শুরু করেছে। মধ্যাঞ্চলে তথা ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, চাঁদপুর এবং মুন্সীগঞ্জে পানিপ্রবাহ বাড়তে থাকবে। দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশে মাত্র বর্ষাকাল শুরু হয়েছে, মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ ও বিস্তার শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ। বর্ষা মৌসুম এখন অক্টোবর পর্যন্ত গড়ায়।
লা নিনার কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত এবং বন্যা হয়। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ’মেডেন জুলিয়ান ওসিলেশন’ (গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার ওঠানামা) এর সম্পর্ক আছে। বর্তমানে ’মেডেন জুলিয়ান ওসিলেশন’ দুর্বল অবস্থায় আছে। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে এটি সক্রিয় হবে। তখন এটি অবস্থান করবে ভারত মহাসাগরের ওপর। এতে বঙ্গোপোসাগরে প্রচণ্ড মেঘ এবং জলীয় বাষ্প তৈরি হবে। বাতাস মেঘের পুরোটাই বাংলাদেশের দিকে নিয়ে আসে। তখনই মেঘালয় ও আসামে অতিভারী বৃষ্টি শুরু হবে। সেই বিবেচনায় জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আরেকটি বন্যার আশঙ্কা আছে।
আবহাওয়া গবেষকদের একটি স্বাধীন দল বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম (বিডব্লিউওটি) তাদের পূর্বাভাসে জানিয়েছে, সিলেট বিভাগে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে কিশোরগঞ্জ জেলা ও যমুনা নদী অববাহিকায় আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জুনের শেষের দিকে ও জুলাইয়ের শুরুতে দেশের উত্তরাঞ্চলে নতুন করে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যাপ্রবণ নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে স্থিতিশীল বা চলতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের (আইডাব্লিউ এফএম) অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুরো বর্ষাকাল জুড়ে বন্যা হতে পারে। অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্তও স্থায়ী হতে পরে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই ব্যাপক বৃষ্টিপাত হওয়ায় এবার বন্যা ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে গাছ এবং পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়গুলো পানি শোষণ করতে পারত। গাছ-পাহাড় কাটার কারণে পানিশোষণ করতে পারছে না। এছাড়া মৌসুমি বায়ু হঠাত্ করে তীব্র শক্তি নিয়ে হিমালয়ের উঁচু পাহাড়গুলোতে আছড়ে পড়ছে, যার ফলে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা এবার বর্ষাকালে একাধিকবার ঘটতে পারে।
নদী বন্দর/এসএফ