‘সবাই তাড়াতাড়ি কাজ করো, বেলা ডোবার আগেই নিরাপদে যেতে হবে’- তাড়া দিচ্ছিলেন টিটু। গৃহিনীরা বাড়ির আসবাবপত্র বস্তায় বাঁধছে। আর উঠানে রাখা ট্রলিতে ভর্তি করা হচ্ছে বাড়ির মালামাল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিবগঞ্জ উপজেলার নমো জগন্নাথপুরের পন্ডিত পাড়ার বাসিন্দা টিটু। পেশায় তিনি একজন কৃষক। মাঝে মধ্যে জীবিকার তাগিদে নৌকাও চালান তিনি। পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষেই তার বসত ভিটা। গ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও গেলে যার মনে শান্তি মিলতো না। আজ সেই টিটুও এ গ্রামের ভিটামাটি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
ঘরের ভিতর থেকে আওয়াজ আসলো- ‘ঘরে চাউল ছাড়া কিছুই নাই। আজকে কী খেয়ে দিন পার করবে? প্রতিউত্তরে টিটু বললেন, ‘আজকের মতো চালাও, কালকে ধার করে দিন কাটাবো।’
এ সময় কথা হয় টিটুর সঙ্গে। টিটু বলেন, ‘পদ্মার পাশেই আমার বাড়ি। খুব তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে কাজ করতে হবে। কাজে ঢিলামি করলে নদীতে ঘরের চাল নেমে যেতে পারে। তাই বেলা থাকতে থাকতে পন্ডিত পাড়া থেকে পাশের গ্রামে চলে যাবো। পরের জায়গায় ঠাঁই নিচ্ছি। ধারদেনা করে ফের ঘর তুলতে হবে।’
স্থানীয়রা জানালেন, ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে আসবাবপত্র নিয়ে নিরাপদ দুরে সরে গেছে পদ্মা পাড়ের প্রায় ৩৫টি পরিবার। মনোহরপুর থেকে উজিরপুরের বালুর ঘাট পর্যন্ত নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদী ভাঙছে। এ নদী আরও প্রায় তিন-চারশ মিটার দূরে ছিলো। আগ্রাসী পদ্মার ভাঙন দিনদিন ভয়াবহ হচ্ছে।
ওই গ্রামেরই হানিফ। তার গায়ের চামড়া কুঁচকানো আর দাড়িগুলোও পেকে গেছে। দেখে মনে হলো বয়স আশির কোঠায়।গায়ে কিছুই নাই, আর মাথায় গামছা। খালি পায়ে পদ্মা নদীর ধারে বারবার আসছেন আর নদীর দিকে তাকাচ্ছেন। বিড়বিড় করে বলছেন, ‘যদি ভাঙনটা থেমে যেতো, তাহলে শান্তি পেতাম।’
জিজ্ঞাসা করলে হানিফ বলেন, ‘১৯৪২ সালে জন্ম। আগের বাড়ি ছিলো নদীর ওপারের গাঁ রঘুনাথপুরে। ৪ বার বাড়ি ভেঙেছি। এলাকায় মায়া বসলেও নিরাপত্তার তাগিদে ছাড়তে হয়েছে নিজের ভিটামাটি। বাপ দাদার থেকে পাওয়া জমি গুলোও নদীতে নেমে গেছে। নদী ভাঙনের তীব্রতা খুবই বেশি।’
পূর্বের কথা স্মরণ করে হানিফ কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘পদ্মা নদীতে ভাঙনের কারণে গতবার কিছুই টানার সুযোগ পাইনি। কয়েকটা টিনের চাল, বাক্স আর গোলায় ভরা ধান আনতে পেরেছিলাম। তাছাড়া সব নদীতে ভেসে গেছিলো । অল্প সময়েই নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’
পদ্মা পাড়ের বাসিন্দা মোরশালিন বলেন, ‘পন্ডিত পাড়া থেকে অনেকে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। ওই গ্রামের সবাই ব্যস্ত সময় পার করছেন। যাদের কোথাও থাকার জায়গা নেই, তারা রাস্তার পাশের পতিত জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন।’
পন্ডিত পাড়ার দফাদার মতিউর রহমান বলেন, ‘প্রতিবছরই এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। গ্রামের শতশত মানুষ তাদের আবাদি জমি হারায়। অনেকের শেষ সম্বল নিজের ভিটামাটিও হারায়। দিনদিন জগন্নাথপুরের আকার-আয়তন ছোট হচ্ছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘নমো জগন্নাথপুরের পন্ডিত পাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন। নদীর পাড় থেকে স্থানীয়রা বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। শিগগির পন্ডিত পাড়াতে জিওব্যাগ ফেলা হবে।’
নদী বন্দর/এসএইচ