‘গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন’ নামে চলমান প্রকল্পের আওতায় নতুন করে সাতটি খাল/পুকুর/জলাশয় সংরক্ষণ, সৌন্দর্য বর্ধন ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়। এ কাজের জন্য চাওয়া হয় ৫৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। তবে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সেই প্রস্তাব ‘না’ করে দেয় কমিশন।
এবার নতুন করে ‘খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য দিঘি খনন’ প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ২১টি দিঘি খনন বাবদ মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৫ কোটি ৮০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। এগুলোর মধ্যে ৭টি দিঘির জন্য ১২ কোটি এক লাখ ১৯ হাজার, ১৩টির জন্য ১৯ কোটি ৯৮ লাখ ২২ হাজার এবং একটি দিঘির জন্য চাওয়া হয়েছে ১৩ কোটি ৮১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
মোট খননের পরিমাণ ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯৯৭ ঘনমিটার। প্রতি ঘনমিটার খননে খরচ পড়বে ৬৯৮ টাকা। এই ব্যয়ের প্রয়োজন ও ভিত্তি সম্পর্কে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে কমিশন।
প্রকল্প প্রস্তাবে প্রতি ঘনমিটার মাটি খনন বাবদ মানুষ দিয়ে খননে ২৩৮ থেকে ২৫০ টাকা ও মেকানিক্যাল এক্সক্যাভেটর দিয়ে খনন করলে ১২৬ টাকা এবং ৩০ মিটারের ৩টি লিফট বাবদ আরও ১২০ টাকাসহ ২৪৬ টাকা ধরা হয়েছে। আনুষঙ্গিক ব্যয় যেমন কাঠের বলি, রিইনফোর্সমেন্ট বা সিমেন্ট কনক্রিটের কাজ, সোলার পাম্পিং সিস্টেমসহ ওভারহেড পানির ট্যাংক, ফুটিং বা গ্রেড বিম ভার্টিক্যাল ওয়াল, পিলার ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়াদি ধরে ঘনমিটার প্রতি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬৯৮ টাকা। এক্ষেত্রে অত্যাধিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে বলে মনে করছে কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুষ্ক মৌসুমসহ সারা বছর পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজাইন অনুযায়ী গভীরতা হবে গড়ে ৫ মিটার। দিঘির পাড় মাটি দিয়ে ঢালু করা হবে যাতে বৃষ্টির গড়ানো বা বন্যার পানি প্রবেশ করতে না পারে। সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি পরিশোধনের জন্য ৪টি দিঘিতে ২টি করে এবং ১৭টি দিঘিতে ১টি করে মোট ২৫টি ‘পন্ড স্যান্ড ফিল্টার’ স্থাপন করা হবে। সুপেয় পানি সংগ্রহ, সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪টি দিঘিতে ২টি করে এবং ১৭টিতে ১টি করে ২৫টি ঘাটলা নির্মাণ করা হবে। চলাচলের সুবিধার্থে দিঘির পাড়ের উপর ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। ভূমিক্ষয় রোধে দিঘির পাড় ঘাসের চাপড়ায় আচ্ছাদিত (টার্নিং) করা হবে।
এছাড়া আনুষঙ্গিক সুবিধা ও ব্যবস্থাপনার জন্য সর্বমোট ৫ হাজার ৩১৪ মিটার সারফেস ড্রেন, ৬২টি কংক্রিটের ছাতা, ৯০টি কংক্রিটের বেঞ্চ, ১৬৬টি কংক্রিটের চেয়ার ও ২২০টি রোপিত বৃক্ষের পেরিফেরিয়াল ওয়াল নির্মাণ করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের উপকূলীয় এলাকায় ওই দিঘিগুলো খননের চেয়ে আনুষঙ্গিক খাতে অধিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। একই সঙ্গে খনন কাজের ব্যয়ও বেশি ধরা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৩টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে পুকুর খননের জন্য দর ৯৯ টাকা, ১৪০ টাকা এবং (ডাবল লিফটিংসহ) ১৮০ টাকা ধরা হয়েছিল। সেই তুলনায়ও প্রস্তাবিত ব্যয়।
আগস্ট ২০২২ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলা; সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, তালা ও আশাশুনি উপজেলা এবং বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে।
রোববার (২০ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হবে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভায় এসব ব্যয় প্রস্তাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। পিইসি সভায় সভাপতিত্ব করবেন কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হক।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে দিঘি খনন প্রসঙ্গে একেএম ফজলুল হক বলেন, বর্তমান বিশ্ব একটা সংকটময় সময় পার করছে। সুতরাং এ ধরনের প্রকল্প অনুমোদনের সময় আমরা আরও সতর্কতা অবলম্বন করবো। আমরা খুবই নিবিড়ভাবে বিষয়গুলো দেখবো।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্পের যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রস্তাবে বলেছে, উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির অভাব দীর্ঘকালের। এছাড়া ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডর, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৩ সালের ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় ফণী ও বুলবুল এবং ২০২০ সালের সুপার সাইক্লোন আম্ফানে উপকূলীয় সুপেয় পানির উৎসগুলো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি মহাসংকটে রূপ নেয়।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় নদ-নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাঁধ কেটে লবণ পানি প্রবেশ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, নদী প্রবাহে বাধা, নদী-খাল দখলসহ নানাবিধ কারণে যুগ যুগ ধরে সুপেয় পানির সংকট অব্যাহত রয়েছে। তাই পুকুর ও দিঘি খনন করে ভূ-উপরস্থ পানি সংরক্ষণ করা আবশ্যক।
ওই প্রস্তাবে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় পানির বিশালতা থাকলেও মিঠা পানির উৎস এবং প্রাপ্যতার ভিত্তিতে সংকট সব সময়ই ছিল। অধিকাংশ স্থানেই ভূগর্ভে খাওয়ার যোগ্য পানির স্তর না পাওয়ায় গভীর নলকূপ চালু করা যায় না। অগভীর নলকূপের পানিতে রয়েছে মাত্রতিরিক্ত লবণাক্ততা ও আর্সেনিক দূষণ। এলাকার মানুষের পানির চাহিদা পূরণের জন্য পুকুর ও রেইনওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান্ট হচ্ছে ভরসা। বৃষ্টির পানি ধারণ করে তা এই প্ল্যান্টের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়।
আবার অপরিকল্পিত চিংড়ির চাষ ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে স্থানীয় পুকুরগুলোর অধিকাংশই মিঠা পানির আধার হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কিছু কিছু এলাকায় রেইনওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান্ট থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এই এলাকার অর্ধেক জনগোষ্ঠী বৃষ্টির পানি ও পুকুরের পানি ফিল্টার করে পান করে। বাকি অর্ধেক পুকুরের পানি পান করে ফিল্টার ছাড়াই।
ফলে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট চলছেই। দিঘি ঘনন করে বৃষ্টির পানি সংক্ষণ করলে এসব অঞ্চলের সুপেয় পানির সংকট মেটানো সম্ভব। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাপাউবো, আইডব্লিউএম এবং সিইজিআইএস গত বছরে গঠিত কারিগরি কমিটির সুপারিশে এ প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) এস. এম. রেজাউল মোস্তফা কামাল বলেন, প্রকল্পটি গ্রহণ করা পুরোপুরি যৌক্তিক বলে আমি মনে করি। কারণ এসব এলাকার মানুষ পানি পায় না। মানুষ যেন পানি পায়, কয়রা ও তালাসহ লবণাক্ত এলাকায় সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এখানের পানির কষ্ট অন্যান্য এলাকার মানুষ অনুভব করতে পারবে না। এখানে টিউবওয়েল দিয়ে পানি পাওয়া কষ্টের। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে এই এলাকার মানুষের বিরাট লাভ হবে।
তবে অর্থনীতিবিদদের দাবি, করোনা পরবর্তী ধাক্কা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তার মধ্যে এমন প্রকল্প না নেওয়াই যৌক্তিক হবে।
এ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে পুকুর খনন বা নতুন প্রকল্প গ্রহণ যৌক্তিক নয়। এখন চলমান প্রকল্প সম্পূর্ণ করার সময়। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন প্রকল্প যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করতে। কারণ এখন সময়টা ভালো যাচ্ছে না। প্রকল্প গ্রহণের আগে প্রায়োরিটি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সময়ে এগুলো প্রয়োজনও নেই বলে আমি মনে করি।
নদী বন্দর/এসএইচ