ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কুষ্টিয়া পাড়া ও ডিগ্রি পাড়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদ ড্রেজিং প্রকল্পের উত্তোলিত বালু চুরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীরা এ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন, নিলামে বিক্রির জন্য রাখা বালু চুরি হয়ে যাওয়ায় সরকার লাখ লাখ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
এদিকে, যেসব কৃষকের জমির উপর নদ থেকে উত্তোলিত বালু স্তূপ করে রাখা হয়েছে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। ফলে সফল চাষাবাদ করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২ হাজার ৭৬৩ দশমিক ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর শুরু হয় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্প। ২০২৪ সালের ৩০ জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনাসহ নানা কারণে এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছরের বেশি বাড়ানো হয়। ফলে ২০২৭ সাল নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী ড্রেজিংয়ে উত্তোলিত বালু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ ভরাট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর বাড়ি করার জন্য বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। অবশিষ্ট বালু নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা হবে।
সম্প্রতি সদর উপজেলার বোররচর ইউনিয়নের কুষ্টিয়া পাড়া ও ডিগ্রি পাড়া এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় ঘেঁষে এক কিলোমিটার দীর্ঘ সারি উত্তোলিত বালুর স্তূপ করে জরিপ চালায় জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। পরবর্তীতে এসব বালু বিক্রির জন্য নিলাম কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তার আগেই স্তূপ করে রাখা বালু প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতে আঁধারে এমনকি দিনের বেলাতেও চুরি করে বিক্রি করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঝে মধ্যে প্রশাসনের লোকজন এলে দুয়েকদিন বন্ধ থাকার পর আবারও শুরু হয় বালু চুরি ও বিক্রি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্তূপ করা বালু দুইটি ভেকু মেশিন দিয়ে তুলে ১০/১২টি লড়ি ও হ্যান্ড ট্রলিতে করে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে। গত এক মাস ধরে এ কর্মকাণ্ড চলছে। তবে গত কয়েকদিনে চুরির পরিমাণ বেড়েছে। আর এসব বালু ভর্তি বাহনগুলো ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় ভূমি অফিসের সামনে দিয়ে বিনা বাঁধায় চলাচল করে। স্থানীয় বোররচর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের যগ্ম আহবায়ক সাদ্দম হোসেনের নেতৃত্বে বালু বিক্রি হচ্ছে বলে স্থানীয় অনেকেই জানিয়েছেন।
কুষ্টিয়া পাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রেজোয়ান হোসেন বাবু নামে এক ব্যাক্তি ভেকু দিয়ে লড়িতে বালু ভর্তি করছেন।
রেজোয়ানের কাছে বালু বিক্রির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। এই এলাকার সাদ্দাম ভাই আমাকে ভেকুসহ ভাড়া করে এনেছেন। বালু কোথায় যাচ্ছে আমি তা বলতে পারবো না। এখানে গাড়ি আসলে বালু ভর্তি করে দেওয়া আমার কাজ। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না।’
বালু কিনতে আসা পাশ্ববর্তী উপজেলা ফুলপুরের মাইচ্ছাপুর গ্রামের রমজান আলী বলেন, ‘এখান অনেকেই বালু কিনতে আসেন। আমিও এসেছি। সাদ্দাম ভাইয়ের কাছ থেকে একটি ছোট হ্যান্ড ট্রলি ভর্তি বালু ৫০০ টাকায় কিনলাম।’
সাদ্দাম হোসেন স্থানীয় রাজনীতির পাশাপাশি পশ্চিম কাচারি বাজারে কীটনাশক ও সার বীজের ব্যবসা করেন।
গত রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সাদ্দামের দোকানে গিয়ে তার সাথে বালু বিক্রির বিষয়ে কথা হয়। সেসময় সাদ্দাম দাবি করেন, তিনি একা এই কাজের সঙ্গে জড়িত নন। স্থানীয়দের বেশ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।
কৃষি জমিতে বালু ফেলে রাখায় ক্ষতি হচ্ছে কৃষকের
সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘এখানে দুইটি পয়েন্টে ভেকু বসানো হয়েছে। ডিগ্রি পাড়া পয়েন্টে আমি, ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহবায়ক জিতু, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নবী হোসেন, হযরত আলী, মালেক ও খোকন মেম্বারসহ আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে। এছাড়াও কুষ্টিয়া পাড়া পয়েন্টে রয়েছেন জালাল, ফারুক মেম্বার, ইমরান মুন্সি, জাতীয় পার্টি নেতা ফুলমিয়া, দেলোয়ার মেম্বার ও রব্বানী মোল্লাসহ আরও অনেকে।’
বালু বিক্রির বিষয়টি সাদ্দাম হোসেন অস্বীকার করে বলেন, ‘এই এলাকায় কৃষকদের জমির উপর বালু ফেলা হয়েছে। তাদের জমি খালি করার জন্য শুধুমাত্র পরিবহন খরচে বালু বিক্রি করা হচ্ছে।’
স্থানীয় কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এলাকার অনেক কৃষকের ফসলের জমির উপর বালু ফেলে পাহাড়ের সমান করে স্তূপ করা হয়েছে। এতে আমাদের অনেক ক্ষতি হলেও আমরা কোনো ক্ষতি পূরণ পাইনি। অথচ এই বালু কয়েকজন মিলে বিক্রি করছেন। দিনে ও রাতে মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় এক থেকে ১৫০ গাড়ি বালু বিক্রি হয়।’
আরও কয়েকজন কৃষক আব্দুর রহমানের মতো ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ক্ষতি হয় আমাদের আর লাভবান হচ্ছে অন্যরা।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘স্তূপ করা বালু বিক্রির জন্য নিলাম কমিটি করা হয়েছে। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মিটিংয়ে নিলামের জন্য দরপত্র আহবানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বালু বিক্রির বিষয়ে মাঝে মধ্যেই আমরা অভিযোগ পাই। অভিযানও পরিচালনা করা হয়। ওই এলাকা উপজেলা হেডকোয়ার্টার থেকে একটু দূরে হওয়ায় কেউ কেউ বালু চুরির সুযোগ নিচ্ছে। তবে যারা বালু চুরি করে বিক্রি করছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
নদী বন্দর/এসএইচ