ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৌলভীবাজারের তিনটি হাওরের তিন শতাধিক কৃষকের লাগানো ব্রি ২৮ ধান নষ্ট হয়েছে। নষ্ট ফসল কেউ জমিতে ফেলে রেখেছেন আবার কেউ গো-খাদ্যের জন্য কেটে নিচ্ছেন।
গোলায় উঠবে না ধান, মিটবে না মহাজনের দেনা। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা। জমি বর্গা এনে সার বীজ, হাল আর শ্রম দিয়ে চাষ করার এখন দিশেহারা তারা।
মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওর। বর্ষার প্রথমে এ তিনটি হাওরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। তাই কৃষকরা সনাতনী ধ্যান ধারণা নিয়ে আগাম ফসল উঠানোর আশায় ব্রি-২৮ ধান রোপণ করেন।
কৃষকদের দাবি, প্রতিকূল আবহাওয়ায় ব্লাস্ট রোগে (স্থানীয় ভাষায় সাদা রোগ) আক্রান্ত হয়ে শতাধিক হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে।
কৃষিবিভাগ বলছে, ব্রি-২৮ রোপণে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু তারা আশপাশের ক্ষেতের সঙ্গে মিল না রেখে সনাতনী ধ্যান ধারণা নিয়ে ব্রি-২৮ চাষ করেছে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় এমন বিপর্যয় এসেছে।
হাকালুকি হাওরের বড়লেখা উপজেলার কাঁঠাল খাউরি এলাকার বোরো চাষি আব্দুল হান্নান বলেন, বর্ষা শুরু হলে আমাদের হাকালুকি হাওরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। তাই আমরা আগাম ধান উঠানোর আশায় ব্রি-২৮ চাষ করেছিলাম। চলতি বোরো মৌসুমে দীর্ঘ খরায় ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার ১০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়েছে।
কথা হলে কুলাউড়া উপজেলাধীন হাকালুকি হাওরের জাবদা গ্রামের প্রান্তিক চাষি মনির মিয়া বলেন, আগাম ধান উঠানোর আশা নিয়ে ব্রি-২৮ রোপণ করে আমাদের সর্বনাশ হয়েছে। এখন না পারি সইতে, না পারি বলতে। ১৫ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়েছে। ঘরে খোরাকি উঠবে না। মহাজনের দেনাও শোধ হবে না। এ নিয়ে হতাশায় আছি।
মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলায় অবস্থিত কাউয়াদীঘি হাওরের কুশুয়া, কাঠারি, উলাউলি, ও মাঝের বান্দ বিল ঘুরে দেখা গেছে- হাজার বিঘা জমি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত। পাকা ধানের ডগা মরে গিয়ে সাদা হয়ে আছে। চাষিরা ক্ষেতের মাঠে গিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন ধান কাটবেন কি-না।
এ সময় কথা হয় হাওর পারের শারমপুর গ্রামের চাষি আকদ্দছ মিয়ার বলেন, প্রথমে দেখা গেছে ধান ভালো হয়েছে। মাস খানেক আগে ধানে সাদা রোগ দেখা দেয়। কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করেও কোনো লাভ হয়নি। এখন বড় বিপদে আছি। আমার আট বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়েছে।
রক্তা গ্রামের বর্গাচাষি সর্দন নম সুত্রের বলেন, আমরা হাওরের নিচু অংশে প্রতি বছর ব্রি-২৮ রোপণ করি। ফসলি জমি ঢলের পানিতে ডুবে গেলেও এ ধানের গাছ দাড়িঁয়ে থাকে। এ সুবিধার কথা চিন্তা করে সর্বনাশ হয়েছে। আমার ছয় বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়েছে।
কাঠারি বন্দের কৃষক আব্দুল মালিক বলেন, এভাবে দুর্যোগ আসবে তারা ভাবতেও পারিনি। পুরো ধানের ছড়ার প্রায় ৯০ শতাংশ চিটা। অনেকে গাছ কেটে গরুকে খাওয়াচ্ছেন। অনেকে দিশেহারা কীভাবে মহাজনের দেনা পরিশোধ করবেন।
শ্রীমঙ্গল হাইল হাওরের চাষি জাহিদ মিয়া বলেন, হাওরের নিচু অংশে ১৫ বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষ করি। ধান যখন পাকা শুরু করলো দেখলাম সব চিটা। কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়েও কোনো কাজ হয়নি।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, উপজেলায় ১১ হাজার ৪৫১ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ব্রি-২৮ ২ হাজার ৬৫১ হেক্টর। বেশ কিছু অংশ ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ রোগের শুরুতে পাতা মরতে শুরু করে। তখনই কৃষকদের দুই রাউন্ড ছত্রাকনাশক স্প্রের পরামর্শ দিয়েছি। একই সঙ্গে ইউরিয়ার পরিবর্তে পটাশিয়াম সার ব্যবহারের পরামর্শ দেই। অনেক কৃষক এ অল্প পাতা মরায় কিছু হবে না ভেবে ছত্রাকনাশক স্প্রে করেননি। কেউ কেউ এক রাউন্ড করেছেন। কিন্তু যারা সঠিক নিয়ম মেনেছেন তাদের ফসল তেমন নষ্ট হয়নি।
রাজনগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, ব্রি-২৮ অনেক পুরাতন একটি জাত। এটি এখন চাষ করতে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করছি। এর পরিবর্তে ব্রি-৮৮ ও ৮৯ চাষের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি।
ব্লাস্ট রোগে কাউয়াদীঘি হাওরে ধানের ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, মৌলভীবাজারের হাইল, কাউয়াদিঘি ও হাকালুকি হাওরের নিচু এলাকায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৬১ হেক্টর বি ২৮ জাতের ধান ও বি ৪৮ জাতের ধান নষ্ট হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। তবে এটি মুল উৎপাদনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এরই মধ্যে কৃষকের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের সহায়তার জন্য সরকারে কোনো বরাদ্দ এলে দেওয়া হবে।
নদী বন্দর/এসএইচ