মৌসুমী বায়ুর প্রভাব ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীর পানি বাড়ছে। সেই সঙ্গে সিরাজগঞ্জের চৌহালী, শাহজাদপুর ও এনায়েতপুরে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। ইতিমধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে স্কুল, বসতবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি। ভিটেমাটি আর বসতবাড়ি হারিয়ে অসহায় নদী পাড়ের মানুষ।
গত ১ জুলাই সকালে প্রবল স্রোতে আকস্মিকভাবে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় সলিমাবাদ পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটা টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার মধ্যে হলেও সীমান্তবর্তী হওয়ায় চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চর সলিমাবাদ গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো এটি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভাঙনের সময় শত শত মানুষ তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের চোখের সামনে নদীগর্ভে বিলীন হতে দেখেও রক্ষা করতে পারেনি। এতে পিছিয়ে পড়া চরাঞ্চলের মানুষের প্রায় দুই শতাধিক ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর নদী ভাঙন রোধে সঠিক সময়ে কোনো কাজ হয়নি। সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন রোধে বরাবরের মতোই কাজ করে যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নদী ভাঙনকবলিত কৈজুরি ইউনিয়নের পাচিল গ্রামের মনি শেখ বলেন, বাবার দেওয়া ৬ বিঘা ফসলি জমি ও ১ বিঘার একটি বসতবাড়ি ছিলো। বাড়িতে অন্তত ৫টি গাভি ছিল। গত কয়েক বছরের ভাঙনে প্রায় সবই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ঘর-বাড়ি ভেঙে সরিয়ে রাস্তার পাশে রেখেছি, এখন নিঃস্ব। আমার জমি যখন ভাঙা শুরু হয়, তখন থেকেই শুনছি নদীতে বাঁধ দেওয়া হবে, কিন্তু সঠিক সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় সব শেষ হয়ে গেল।
এনায়েতপুরের ব্রাহ্মণ গ্রামের মজিবর শেখ বলেন, এক সপ্তাহে অনেক বসতভিটা ও কয়েকশ বিঘা ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেল। ভাঙন বন্ধ করতে কোনো কাজ শুরু তো দূরের কথা, কেউ খোঁজ খবর নিতেও আসেনি।
জালালপুরের পাকরতোলা গ্রামের সুফিয়া বেগম বলেন, আমাদের বাড়ি ছিল কৈজুরির পাচিলে। সেখানে ভাঙনে আমাদের বসতভিটা নদীতে চলে যাওয়ায় পাকরতোলা এসে ঘর তুলেছি। এখন এই বাড়িও নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। দুবছর আগেও গোয়ালে গরু, গোলাভরা ধান ছিল। এখন আমরা নিঃস্ব। ভাঙন রোধে কাজ শুরু না হলে আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।
এদিকে, চলতি বছরের ২ জুন চৌহালী উপজেলার খাষপুখুরিয়া থেকে চর সলিমাবাদ পর্যন্ত নদীতীর সংরক্ষণ বাঁধের কাজ শুরু হয়। এর উদ্বোধন করেন পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম। তবে উদ্বোধনের ১৩ দিনের মাথায় নির্মাণাধীন বাঁধ এলাকা থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের অভিযোগে দুই শ্রমিককে কারাদণ্ড ও বাঁধ নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন স্থানীয় প্রশাসন। ফলে এ অংশে ভাঙনের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়।
অপরদিকে, কাজ বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদে চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের অপসারণ দাবিতে ১৫ ও ১৭ জুন এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন।
সলিমাবাদ পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সামাদ জানান, বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় গত বছর ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০০ ফুট লম্বা একতলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ভবনটি নদীগর্ভে চলে গেছে। এর আগেও পুরাতন ভবনটিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ে পাঠদান করার মতো আর কিছু রইলো না। তবে ঈদের কারণে এ মাসের ৯ জুলাই পর্যন্ত বিদ্যালয় ছুটি রয়েছ। ছুটি শেষে অন্যত্র খোলা আকাশের নিচে পাঠদান শুরু হবে।
নাগরপুর উপজেলার সলিমাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহীদুল ইসলাম অপু বলেন, যমুনার ভাঙন কিছুতেই রোধ করতে পারছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে শত শত মানুষ।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমি বাঁধ নির্মাণ কাজ বন্ধ করিনি।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে যমুনায় পানি বাড়ার কারণে চৌহালীসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
নদী বন্দর/এসএস