বাংলাদেশ আগামী ৭ জানুয়ারি যখন সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন দেশটিতে তীব্রভাবে আলোচনা হচ্ছে প্রতিবেশী ভারতের ভূমিকা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা চতুর্থ মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হতে চাইছেন এবং প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় তার জয় অনিবার্য মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা বলেছে, শেখ হাসিনা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন বলে তাদের কোনও বিশ্বাস নেই। তারা তাকে পদত্যাগ করতে এবং একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করতে দাবি করেছে।
তবে বিরোধীদের এই দাবি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশকে প্রায় তিন দিক দিয়ে ঘিরে আছে ভারত। এর বাইরে কেবল দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটার (১৬৮ মাইল) দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।
অবশ্য ভারতের কাছে বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী দেশ নয়। এটি ভারতের কৌশলগত অংশীদার এবং একটি ঘনিষ্ঠ মিত্রও। কারণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার জন্য ভারতের কাছে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাই ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের যুক্তি, দিল্লির জন্য ঢাকায় একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার প্রয়োজন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনা ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন এবং দিল্লি আবারও তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায়, এটা কোনও গোপন বিষয় নয়।
অন্যদিকে শেখ হাসিনা বরাবরই দিল্লির সঙ্গে ঢাকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ন্যায্যতা দিয়েছেন। ২০২২ সালে ভারত সফরের সময় তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন ভারতকে ভুলে না যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত, তার সরকার, জনগণ এবং সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
অবশ্য আওয়ামী লীগ দলের প্রতি এই সমর্থন বিরোধী দল বিএনপি থেকে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সিনিয়র বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বিবিসিকে বলেছেন, ‘ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন করা, কোনও বিশেষ দলকে নয়। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায় না।’
রিজভী আরও বলেন, দিল্লি শেখ হাসিনার জন্য প্রকাশ্যে শিকড় গেড়ে এবং ‘ডামি নির্বাচনকে’ সমর্থন করে ‘বাংলাদেশের জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন’ হয়ে গেছে।
এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বাংলাদেশের নির্বাচনে দিল্লির হস্তক্ষেপের বিষয়ে বিএনপির অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, ‘নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এতে বাংলাদেশের জনগণ তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে আমরা সেখানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চাই।’
অবশ্য ভারত নিজেও উদ্বিগ্ন যে, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী দলের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে পারে। যেমনটি ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে জোট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় হয়েছিল।
ঢাকায় কাজ করা সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার ড. পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বিবিসিকে বলেছেন, ‘তারা অনেক জিহাদি গ্রুপের জন্ম দিয়েছে যা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। যার মধ্যে ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টা এবং পাকিস্তান থেকে আসা অস্ত্র ভর্তি ১০টি ট্রাক আটকের ঘটনাও ছিল।’
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই শেখ হাসিনা ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে দিল্লির আস্থা অর্জন করেন। এসব জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েকটি আবার বাংলাদেশ থেকেও পরিচালিত হতো।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক, জাতিগত ও ভাষাগত সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাঙালি প্রতিরোধ বাহিনীর সমর্থনে সৈন্য প্রেরণের মাধ্যমে দিল্লি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চাল, ডাল এবং শাকসবজির মতো অনেক প্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়ার বিষয়ে ঢাকা দিল্লির ওপর নির্ভরশীল। আর তাই রান্নাঘর থেকে ভোটের ব্যালট পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারত প্রভাবশালী। অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশকে ৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ দিয়েছে ভারত।
কিন্তু কয়েক দশক ধরে পানিসম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ থেকে শুরু করে একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়েও সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
ঢাকায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসিকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ভারতের ভাবমূর্তিগত সমস্যা রয়েছে। এটি এই উপলব্ধি থেকে আসছে যে, বাংলাদেশ ভালো প্রতিবেশীর কাছ থেকে সেরা আচরণটা পাচ্ছে না।’
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন এবং তার দল পরে আরও দুটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। যদিও সেই নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ এ অভিযোগ অস্বীকার করে থাকে।
যদিও ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সড়ক, নদী এবং ট্রেনের অ্যাক্সেস পেয়েছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, ঢাকা এখনও ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে স্থলবেষ্টিত নেপাল এবং ভুটানের সাথে সম্পূর্ণভাবে ওভারল্যান্ড বাণিজ্য করতে পারছে না।
ঢাকায় বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার থাকার পেছনে ভারতের অন্যান্য কৌশলগত কারণও রয়েছে। দিল্লি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তার উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যে সড়ক ও নদীপথে পরিবহনের সুবিধা চায়।
এখন ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বে যেতে রাস্তা এবং ট্রেনের সংযোগ ‘চিকেনস নেক’-এর ওপর নির্ভরশীল। এটি মূলত ২০ কিমি (১২ মাইল) দীর্ঘ স্থল করিডোর যা নেপাল, বাংলাদেশ এবং ভুটানের সীমান্তে অবস্থিত। দিল্লির কর্মকর্তারা ভয় পাচ্ছেন, ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাথে যেকোনও সম্ভাব্য সংঘর্ষে এই স্থানটি দিল্লির জন্য কৌশলগতভাবে দুর্বল পয়েন্ট হবে।
যদিও বেশ কয়েকটি পশ্চিমা সরকার কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ওপর অতিরিক্ত আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চেয়েছিল, তবে ভারত এই ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে তা প্রতিহত করছে। এছাড়া ভারতের সাথে আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াইয়ে বাংলাদেশে নিজের পদচিহ্ন প্রসারিত করতে আগ্রহী চীনও।
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক ড. পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘আমরা পশ্চিমাদের জানিয়েছি, আপনারা যদি শেখ হাসিনাকে চাপ দেন, তাহলে তিনি চীনা শিবিরে চলে যাবেন, যেমনটা অন্যান্য দেশও করেছে। এটি ভারতের জন্য কৌশলগত সমস্যা সৃষ্টি করবে। আমরা এটি মানতে পারব না।’
ভারত ও বাংলাদেশের দুই সরকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারতের বিষয়ে কিছু বাংলাদেশিদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। জমিরউদ্দিন নামে ঢাকার একজন সবজি ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি মনে করি না ভারতীয়রা সব ক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ণ। আমরা একটি মুসলিম জাতি হওয়ায় ভারতের সাথে আমাদের সবসময় সমস্যা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের আগে নিজেদের রক্ষা করতে হবে এবং তারপর অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। অন্যথায়, আমরা সমস্যায় পড়ব।’
ভারত যখন বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তখন বাংলাদেশের অনেকেই আবার সীমান্তের ওপারে (ভারতে) কী ঘটছে তা নিয়ে চিন্তিত।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, ভারতে ২০১৪ সালে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য বেড়েছে। যদিও এই অভিযোগ বিজেপি অস্বীকার করে থাকে।
ভারতীয় রাজনীতিবিদরাও ‘বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের’ কথিত অনুপ্রবেশের বিষয়ে প্রায়ই কথা বলে থাকেন। এমনকি আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানদের ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ অংশ হিসাবে দেখা হয়।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলছেন, ‘ভারতীয় মুসলমানদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হলে তা বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু সংখ্যালঘুদের সাথে দুর্ব্যবহার করার উচ্চ সম্ভাব্য সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।’
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ হিন্দু। দিল্লি স্পষ্ট যে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে সেটি তাদের স্বার্থের জন্য ভালো। কিন্তু ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জিং অংশটি হবে, বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছানো।
নদী বন্দর/এসএইচবি