মেঘনা গ্রুপের নদী চুরির নিয়ে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। এ ঘটনা নিয়ে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়। মেঘনা গ্রুপের নদী দখলের বিষয়টি তোলপাড় তুলেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের গঠিত ১২ সদস্য তদন্ত কমিটি দীর্ঘ দুই বছর সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদনটি গত ১৪ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেয়।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের ওই প্রতিবেদনে নানা তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই শিল্পগ্রুপ বছরের পর বছর প্রভাব খাটিয়ে ও মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে নদী গিলে ফেলেছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে গিয়ে মেঘনা গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠান প্রবাহমান মেঘনা নদীর ২৪১ দশমিক ২৭ একর জমি অবৈধ দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৭৭ একর নদীর জমিতে মূল ভবন নির্মাণ করেছে তারা। আবার ৫ দশমিক ৫ একর জমিতে নির্মাণ করেছে নিজস্ব রাস্তা।
অবৈধভাবে দখল করা এসব জমি এক মাসের মধ্যে উদ্ধার করে নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক, বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এ ছাড়া নদী রক্ষায় ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করেছে জাতীয় নদী কমিশন। বিশেষজ্ঞদের মতে, কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক এক্ষুণি ব্যবস্থা নিতে না পারলে দখলদারদের কবল থেকে নদী উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিশেষ করে মেঘনা নদীর ক্ষেত্রে এটি আরো কঠিন হবে। কারণ এর আগে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে মেঘনা নদী দখলদকারি মদীনা গ্রুপের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মেঘনা গ্রুপের দখলকৃত নদীর জায়গা উদ্ধার করা হয়নি।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার স্বাক্ষরিত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়গঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলা এলাকায় মেঘনা গ্রুপ প্রবাহমান মেঘনা নদী দখলের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার জন্য ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সকল সদস্য তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে কিন্তু দুর্ভাগ্যবত ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে কমিটির তদন্ত কার্যক্রম কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে।
পরে তা আবারো কার্যক্রম শুরু করে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে মেঘনা শাখা নদী মারাখালী নদীর অংশের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের পাড় থেকে নদীর ভেতরে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত দখল করার অভিযোগ উঠেছে। মেঘনা নদীর অন্তত ৩০০ বিঘা জমি দখল করেছে মেঘনা গ্রুপ। দখলকৃত স্থানে ইতোমধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে মেঘনা গ্রুপের মালিকানাধীন ফ্রেস টি ফ্রেস সুগার মিলস, পেপার মিলস, কেমিক্যাল ফ্যাক্টারিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান। ভূমি দস্যুতার এই প্রতিযোগিতায় পিঠিয়ে নেই মেঘনার পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলোও।
গ্রুপের ভাগ্নিজামাই বলে পরিচিত আল মোস্তফার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গ্রুপ ও নদী দখল করে ব্যাগের কারখানা গড়ে তুলেছেন। যা বিগত ২০১০ সাল থেকে ধাপে ধাপে এবং একটু একটু করে এসব জমি দখল করে নেয়া হয়। মেঘনা গ্রুপের এমন অবৈধ দখলে ভরাট হওয়ায় সাধারন গতিপথ হারাতে বসেছে প্রবাহমান মেঘনা। নদী ডাকাতির এক কর্মকাণ্ডে অস্তিত্ব সংকটের হুমকিতে আছে আশেপাশের নদী সংলগ্ন বিভিন্ন নিচু এলাকা ও চরে জমিগুলো।
আনন্দ বাজার এলাকায় মেঘনা নদীর প্রায় ৫০০ ফুট জায়গা দখল করে মাটি ভরাট করেছে মেঘনা গ্রুপ এবং প্রায় ৫০ একর জমি। পিরোজপুর ইউনিয়নের ছয়হিস্যা জৈনপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০০ বিঘা জমি গ্রাস করেছে। আষাড়িয়ার চড় ও ঝাউচর এলাকায় নদীর অধিকাংশ বালু ভরাট করেছে। নদীর প্রায় ৭০০ ফুট দখল করে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছে মেঘনা গ্রুপ।
ওই জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বলেন, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনটি আমরা এখনো পাইনি। তবে গত ২৮ জানুয়ারি জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের সাথে এ বিষয়ে সভা হয়েছে। মেঘনা গ্রুপের নদী দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সোনারগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতিকুল ইসলামের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশে মদিনা গ্রুপের দখলে থাকা নদী ও নদীর তীরবর্তি সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু মেঘনা গ্রুপের দখলে থাকাই নয় ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের দখলের তালিকা করে জেলা প্রশাসকের নির্দেশক্রমে নদীর জায়গা উদ্ধারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মেঘনা গ্রুপের দখলে থাকা নদীর জায়গা দখলমুক্ত করতে একাধিকবার অভিযান শুরু হলেও মাঝপথে তা আটকে গেছে। এরপর আর সেখানে অভিযান পরিচালিত হয়নি। এতে করে অন্যান্য দখলদাররাও ছাড় পেয়ে গেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
নদী বন্দর / এমকে