মিয়ানমারে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশটির রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন এপার-ওপারে থাকা তাদের স্বজনরা। রাখাইন থেকে অনেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার জন্য রোহিঙ্গা শিবিরে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মিয়ানমার অংশে দেশটির সেনারাও টহল বাড়িয়েছে। সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্তে তুমবুরু ও ঘুনধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সেনা তৎপরতা বেড়েছে। সেনারা সীমান্ত এলাকায় বাংকার খনন করছে। এদিকে সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও (বিজিবি) সতর্ক টহল ও নজরদারি জোরদার করেছে। নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় বিজিবি টহল দিচ্ছে। তিন দিন ধরে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী লোকজনও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে বিজিবি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ শিবিরের রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থাকা রোহিঙ্গারা সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ে এপারে থাকা স্বজনদের কাছে খোঁজখবর নিচ্ছে। এ কারণে শিবিরের রোহিঙ্গাদেরও শঙ্কা, রাখাইনের পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে আবারও রোহিঙ্গারা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে।
টেকনাফের শালবাগান শিবিরের মোহাম্মদ শওকত নামের এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘মিয়ানমারের ভুসিডং এলাকায় আমাদের বসবাস ছিল। ২০১৭ সালের আগস্টে পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমি আমার পরিবারকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। কিন্তু আমার চাচা, ভাইসহ অনেক আত্মীয়-স্বজন তখন থেকে ঝুঁকি নিয়ে সেখানে রয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে সেখানে বসবাস করতে তাদের তেমন সমস্যা হয়নি। তবে এবার সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা এখন খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছে। সেনা শাসনে তাদের ওপর নতুন করে কোনো নিপীড়ন হবে কি না, তা নিয়েও তারা আতঙ্কে আছে।’
শওকত আরো বলেন, ‘ওপারে থাকা আত্মীয়-স্বজন বাংলাদেশে চলে আসতে তাদের কাছে বারবার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্ত পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা এলে দেশে ঢুকতে পারবে।’
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের ছলেমা খাতুন বলেন, ‘মংডুতে এখনো আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন থেকে গেছে। তারা এত দিন সেখানে নিরাপদে ছিল। মগ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা কিছুটা ভয়ে আছে। এখন যারা ক্ষমতা নিয়েছে, এই সেনাবাহিনীই রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের পুরোটা অংশজুড়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারা এখন সেখানকার রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক হবে সে রকম আশা করা যাচ্ছে না।’
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘আমরা আশা করছি মিয়ানমারের নতুন সেনা প্রশাসন বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসন বিষয়ে অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। আর কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসুক, সেটা আমাদের মোটেও কাম্য নয়। আমরা চাচ্ছি, প্রত্যাবাসন আলোচনা অব্যাহত রেখে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার সুযোগ সৃষ্টি হোক।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গা স্বজনরা এপারে চলে আসার পরামর্শ চাইলে আমরা তাদের আসার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছি। নতুন করে কোনো রোহিঙ্গার আগমন ঘটলে, আগে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়াও ভেস্তে যেতে পারে।’
তবে মিয়ানমারের রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেন এমন কয়েকজন রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সেনা নির্যাতনের শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ নূর নামের কুতুপালং শিবিরের একজন রোহিঙ্গা নেতা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের যে সেনাবাহিনী ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতা চালিয়েছিল, তারা আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে সেই ঘটনা নিয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতের রায়েও তারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। সেই সেনাবাহিনী নতুন করে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর আবার অত্যাচার-নির্যাতন চালাবে বলে মনে হয় না।
এদিকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বাড়তি নজরদারি বাড়িয়েছে বিজিবি। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের জলসীমায় নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের টহলও জোরদার করা হয়েছে।
প্রসংগত ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইনে কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার অভিযোগ তুলে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চলে। দেশটির সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গণহারে হত্যা, ধর্ষণ ও ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় প্রাণ বাঁচাতে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে আরো যেসব রোহিঙ্গা এসেছে তাদেরসহ সব মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে আশ্রিত। তাদের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ের ৩৪টি শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
নদী বন্দর / এমকে