মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘তেহরান খালি করে দেওয়ার’ বার্তায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। তেহরানের রাস্তায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কে ঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ যানজট। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের বক্তব্য কোনো সাধারণ হুমকি নয়—এটি বড় ধরনের সংঘাতের ইঙ্গিত।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, অনেকে আশঙ্কা করছেন ইসরায়েল এবার তেহরানে সরাসরি হামলার পরিকল্পনা করছে।
ইরানও পিছপা হচ্ছে না। তারা নিজেদের অবস্থানকে ‘ডু অর ডাই’ বলেই ব্যাখ্যা করছে। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর হুমকির পর—খামেনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এক্স-এ (সাবেক টুইটার) খামেনি লেখেন, ‘মর্যাদাবান হায়দারের নামে, যুদ্ধ শুরু হলো।’ তিনি যখন এই পোস্ট করছেন, ততক্ষণে বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে তেহরান, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তেল আবিব। পঞ্চম দিনের প্রাণঘাতী সংঘাতে বাতাসে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। জীবন বাঁচাতে তেহরানের মানুষ শহর ছাড়ছেন। ইসরায়েলিরা বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ কেউ দেশও ত্যাগ করছেন।
সোমবার সন্ধ্যায় ইরানের রাজধানী তেহরানে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সময় হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। হামলা হয়েছে একাধিক হাসপাতালে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ইমাম খামেনি হাসপাতালে। রক্তে ভেসেছে হাসপাতালের চত্বর, আহতদের উপচে পড়া ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। একজন চিকিৎসক একে ‘রক্তস্নান’ বলেও মন্তব্য করেছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে— তারা ইরানের যুদ্ধকালীন চিফ অব স্টাফ আলি সাদমানিকে হত্যা করেছে। একই সঙ্গে ইস্পাহানে আরও তিনজন নিহত হয়েছেন। তবে এদের মৃত্যু কখন হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
এদিকে ইরানি গণমাধ্যম জানাচ্ছে, তারা ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ইতিহাসের ‘সবচেয়ে বড় ও তীব্র’ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসরায়েল হামলা করছে যেমন, তেমনি ইরানও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেছে।
ইসরায়েল যেন ইরানের সামরিক, গোয়েন্দা এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এমনকি হাসপাতাল ও টিভি স্টেশনেও হামলা চালানো হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। তেল ডিপোতেও হামলা হয়েছে। এসব ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, ইরান এখন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে নেমে পড়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেছেন, খামেনির পরিণতি হবে ইরাকের সাবেক নেতা সাদ্দাম হোসেনের মতো। পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরায়েল ইরানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চায়। তবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন মনে করেন, জোর করে শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাতের চেষ্টা কৌশলগত ভুল হবে।
এই অবস্থায় তড়িঘড়ি করে কানাডার জি-৭ সম্মেলন ছেড়ে নিজ দেশে ফিরেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার টিম। বিষয়টি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছে। এজন্য প্রস্তুতি নিতে দ্রুত দেশে ফিরেছেন ট্রাম্প। এরই অংশ হিসেবে ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করা হয়েছে যুদ্ধজাহাজ ‘নিমিটজ’। আবার কেউ মনে করছেন, ট্রাম্প যুদ্ধ থামাতে চান এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি যুদ্ধের সত্যিকারের অবসান চান, শুধু অস্ত্রবিরতি নয়।
তেহরানের সাধারণ মানুষকে শহর ছেড়ে পালানোর সতর্কতা দিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র রাখতে দেবেন না। অন্যদিকে নেতানিয়াহু বলেছেন, খামেনিকে হত্যা করা হলে সংঘাত বাড়বে না, বরং সেটিই যুদ্ধের ইতি টানবে।
তবে বাস্তবতা হলো—উভয় পক্ষই এখনো শান্তির পথে হাঁটছে না। ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরান আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। রেভ্যুলুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই ইসরায়েলের ওপর নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের ঢেউ আছড়ে পড়বে।
সোমবার দিবাগত রাতের ইরানি হামলা ছিল এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জোরালো। তাতে ইসরায়েলের বেশ কিছু সামরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেছে ইরান। মঙ্গলবার তারা ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতর ও মোসাদের অপারেশনাল সেন্টারে হামলা চালিয়েছে বলে জানায়। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন তাসনিম নিউজ কিছু ছবি প্রকাশ করেছে, যাতে মোসাদের সদর দপ্তরে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তবে ইসরায়েল এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে হুমকি মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের বক্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে চায় ওয়াশিংটন। ট্রাম্প বলেন, তিনি সংঘাতের সত্যিকারের অবসান চান, যা হতে হবে পারমাণবিক ইস্যু সমাধানের মধ্য দিয়ে।
অন্যদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ইসরায়েলের হামলা সত্ত্বেও তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হবে। এনপিটি চুক্তি থেকে সরে আসার পর যুক্তরাষ্ট্র নড়েচড়ে বসেছে। ইউরোপে জ্বালানিবাহী বিমান পাঠাচ্ছে তারা। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ জানিয়ে দিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করছে।
ইরানের সঙ্গে আলোচনা করতে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ বা ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সকে পাঠানো হতে পারে। বিষয়টি জানিয়েছেন ট্রাম্প নিজেই। সিবিএস নিউজ জানায়, ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ করতে চান, তবে এর শর্ত হলো—ইরানকে অবশ্যই পারমাণবিক আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়ে স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসে ম্যানুয়েল আলবারেস বলেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ চলতে থাকলে ইউরোপীয় অংশীদারদেরও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা উচিত। একই সঙ্গে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক ইস্যুতে আবার সংলাপে বসার আহ্বান জানান তিনি।
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন শান্তির জন্য যেভাবে সক্রিয় হয়েছিল, এবারও সে রকম ভূমিকা নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন আলবারেস।
এদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মধ্যপ্রাচ্যের চলমান উত্তেজনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কাজাখস্তানের আসতানায় উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিয়োয়েভের সঙ্গে বৈঠকে শি বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল সামরিক অভিযান শুরু করায় পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। চীন এর বিরোধিতা করে। তিনি বলেন, চীন এমন যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করে যা অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে লঙ্ঘন করে।
নদীবন্দর/এএস