দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীপক্ষকে দমনে অ্যাডলফ হিটলারের ফ্যাসিবাদকে অনুকরণ করতেন। সেই অনুযায়ী তিনি ২০১৩ সালে একটি বিশেষ রাজনৈতিক শ্রেণিকে নির্মূলের লক্ষ্যে জনমত তৈরির জন্য দিনের পর দিন গণজাগরণ মঞ্চের নামে শাহবাগে বিক্ষোভের আয়োজন করেন। সে সময় শাহবাগের কিছু বিক্ষোভকারীর নির্দেশে সরকার পরিচালিত হতে থাকে। এতে পার্শ্ববর্তী হেজিমনিক ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের জবানবন্দি গ্রহণ করে। মামলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর জবানবন্দি পেশ করেন মাহমুদুর রহমান। তিনি মামলার ৪৬তম সাক্ষী।
মাহমুদুর রহমান বলেন, গণজাগরণ মঞ্চের নির্দেশে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিদের ফাঁসির দাবিতে সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। স্বয়ং হাসিনা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, এরা সবাই দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা। আমি মানসিকভাবে সারাক্ষণ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চেই থাকি। ঢাকায় সফররত ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেন, প্রটোকলে বাধা না হলে আমিও শাহবাগে গিয়ে সংহতি জানাতাম। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় এই তথাকথিত আন্দোলনে পার্শ্ববর্তী হেজিমনিক ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল। শাহবাগের এই আন্দোলনের ফলে আপিল বিভাগ আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজাকে রেট্রোস্পেকটিভ ইফেক্ট দিয়ে ফাঁসির রায়ে উন্নীত করে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে চরম অবিচারের উদাহরণ হয়ে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা পারিবারিকভাবে সেনাবিদ্বেষী ছিলেন। তিনি ও তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই সেনাবিদ্বেষী ছিলেন। পিলখানায় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য প্রথমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পদক্ষেপ নেন।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ টেনে মাহমুদুর রহমান বলেন, শাপলা চত্বরে গণহত্যার কিছুদিন আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার চলছিল। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন নিজামুল হক নাসিম। তিনি বিচারের নামে যে অবিচার করেছিলেন তার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল দৈনিক আমার দেশ ও লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা। নিজের বেঞ্চের মামলা নিয়ে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক জিয়া উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতেন বিচারপতি নিজামুল হক। তাদের স্কাইপ কথোপকথনের প্রমাণ ও ইমেইল আমার দেশ ও ইকোনমিস্টের কাছে পৌঁছায়।
সেই কথোপকথনে দেখা যায়, একটি তামাশায় পরিণত হয়েছিল পুরো বিচারপ্রক্রিয়া। সাক্ষীর জেরার প্রশ্নোত্তর থেকে শুরু করে খসড়া রায় লিখে দেওয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল, বিদেশে থাকা জিয়া উদ্দিন ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল-মালুম নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে আগে থেকেই নির্ধারণ করেছিলেন। এর একটি উদাহরণ হলো, জেয়াদ আল-মালুমকে আগে থেকেই বিচারপতি নিজামুল বলতেন, বিচার চলাকালে তিনি যেন মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে অবজেকশন জানান। পরে তাকে বসিয়ে দেবেন বিচারপতি নিজামুল। ভাষাটা এমন ছিল— আপনি দাঁড়াইয়া যাবেন আর আমি বসাইয়া দিমু, সবাই মনে করবে আমাদের খাতির নেই।
বিচারপতি নিজামুলের পদোন্নতির বর্ণনাও দেন আমার দেশ সম্পাদক। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি এসকে সিনহার কাছে অনেকবার নিজের পদোন্নতির জন্য আবদার করেছিলেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক। জবাবে সিনহা বলেছেন, পদোন্নতির আগে কয়েকটি রায় দিয়ে আসতে হবে। কেননা তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সিনহার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সব মিলিয়ে স্কাইপ ও ইমেইলে পাওয়া সব নথিই পরিষ্কার করেছিল এসব মামলার রায় পূর্বনির্ধারিত। জনগণকে বোকা বানানোর জন্য বিচারের নাটক করা হয়েছিল। তবে এ সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর পদত্যাগে বাধ্য হন বিচারপতি নিজামুল।
মাহমুদুর রহমান বলেন, পদত্যাগ করলেও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন এই চেয়ারম্যানকে। উল্টো তাকে পুরস্কার হিসেবে কিছুদিনের মধ্যে হাইকোর্টে বেঞ্চ দেওয়া হয়। এরপর পদোন্নতি দিয়ে আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। এমনকি বিচারপতির চাকরি থেকে অবসরের পর তাকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। অর্থাৎ জনগণকে ফ্যাসিস্ট সরকার বুঝিয়ে দিল যে, সবরকম অন্যায় করার অধিকার তাদের রয়েছে।
এ ছাড়া আজকের জবানবন্দিতে আওয়ামী দুঃশাসনের পুরো চিত্র তুলে ধরেন মাহমুদুর রহমান। বেলা ১১টা ২০ মিনিট থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলে। মাঝে এক ঘণ্টার বিরতির পর ফের শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
নদীবন্দর/ইপিটি