সারা দেশে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে পরীক্ষাসহ সব প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে স্কুলে স্কুলে ঝুলছে তালা, বার্ষিক পরীক্ষাও হচ্ছে না। মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) সরেজমিনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, কোথাও পরীক্ষা শুরু হয়নি।
দেশের সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মবিরতির কারণে পাঠদান, প্রশাসনিক কাজ ও বার্ষিক পরীক্ষা পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির আহ্বানে তিন দিনের ধারাবাহিক কর্মবিরতি পালন করছেন শিক্ষকরা। এই কর্মসূচির ফলে বিভিন্ন জেলার স্কুলগুলোতে তালা ঝুলছে; শিক্ষকরা উপস্থিত থাকলেও কোনো শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছেন না। এতে শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছে, অভিভাবকদের মধ্যেও বাড়ছে উদ্বেগ।
শিক্ষকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে তারা প্রশাসনিক জটিলতা, পদোন্নতির স্থবিরতা এবং গ্রেড–সংক্রান্ত বৈষম্যের মধ্যে কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, পাঠদান, পরিদর্শন ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তাদের পদমর্যাদা ও সুবিধা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করা হয়নি। এ অবস্থায় শিক্ষা ব্যবস্থার স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মাঠপর্যায়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা।
সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির চার দফা দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন কয়েক দিনের মধ্যেই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, সহকারী শিক্ষক পদকে নবম গ্রেডে উন্নীত করে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের দাবি, ক্যাডারভুক্ত না হলে পদোন্নতির সুযোগ সীমিত থেকে যাবে এবং প্রশাসনিক কাঠামোয় সমতা ফিরবে না।
পাশাপাশি দ্রুত সময়ে আলাদা মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করে এর গেজেট প্রকাশের দাবিও দীর্ঘদিনের। শিক্ষকদের অভিযোগ, অধিদপ্তর না থাকায় স্কুল ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয় এবং অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হলো বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় শিক্ষকদের শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া। দীর্ঘদিন ধরে বহু পদ শূন্য থাকায় শিক্ষকরা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে এবং শিক্ষকসংকটের কারণে স্কুল পরিচালনা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
শিক্ষকরা বলছেন, প্রশাসনিক জটিলতায় পদোন্নতি ও পদায়ন প্রক্রিয়া আটকে থাকার কারণে অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়েছে।
তৃতীয় দাবি হলো সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বকেয়া টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরি আদেশ দ্রুত বাস্তবায়ন করা। অনেক শিক্ষক বহু বছর ধরে এই সুবিধা পাচ্ছেন না, যা আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি পেশাগত অগ্রগতিও ব্যাহত করছে। সমিতি তিন কর্মদিবসের মধ্যে এই আদেশ বাস্তবায়নের আল্টিমেটাম দিয়েছে।
চতুর্থ দাবি অনুযায়ী, ২০১৫ সালের আগে কার্যকর থাকা সহকারী শিক্ষকদের জন্য দুই থেকে তিনটি ইনক্রিমেন্টসহ অগ্রিম বর্ধিত বেতন সুবিধা পুনর্বহাল করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। তাদের বক্তব্য, এই সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেতনে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, যা হতাশা ও অসন্তোষ বাড়িয়েছে।
গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষক মঞ্জুরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের তিন দিনের কর্মবিরতি চলছে, তাই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাজ হচ্ছে না।’
পরীক্ষা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কর্মবিরতিতে থাকায় আমরা পরীক্ষা নিচ্ছি না। বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সিদ্ধান্তের বাইরে আমরা যাব না। দীর্ঘদিনের বৈষম্য সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় শিক্ষকরা কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছেন।’
এদিকে কর্মবিরতির ফলে স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষার সময়সূচি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। অনেক স্কুলে পরীক্ষার কক্ষ প্রস্তুত থাকলেও শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করছেন না। এতে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি ব্যাহত হচ্ছে, পরীক্ষার তারিখ পুনর্নির্ধারণ নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। অভিভাবকেরা বলছেন, বছরের শেষ সময়ে এমন স্থবিরতায় শিশুদের মানসিক চাপ বাড়ছে এবং শিক্ষাবর্ষের সমাপ্তিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শিক্ষক সমিতির দাবি, সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি না হলে কর্মসূচি আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। দ্রুত সমাধান হলে শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরতে পারবেন এবং পরীক্ষা পুনরায় শুরু করা যাবে। তবে শেষ পর্যন্ত আলোচনা কত দূর এগোয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়-তা-ই নির্ধারণ করবে শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাভাবিকতা ফিরতে কত সময় লাগবে।
নদীবন্দর/এএস