পাবনা সদর উপজেলার মালঞ্চি ইউনিয়নের ১০ গ্রামের অন্তত দু’ হাজার মানুষের অন্যতম পেশা মুড়ি ভাজা। কয়েক প্রজন্ম ধরেই মুড়ি তৈরির কাজে নিয়োজিত এসব গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। এ কারণে এই গ্রামগুলো মানুষের কাছে ‘মুড়ি গ্রাম’ নামে পরিচিত। বাজারের ইউরিয়া মিশ্রিত মুড়ির চেয়ে এই গ্রামগুলোতে হাতে ভাজা লবণ পানির তৈরি মুড়ি খুব সুস্বাদু ও ব্যাপক সমাদৃত।
রমজান মাস ঘিরে দারুণ ব্যস্ত সময় পার করছেন পাবনার মুড়ি গ্রামের নারী-পুরুষ। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে তাদের এই ব্যস্ততা। তাদের দীর্ঘদিনের শ্রম ও সাধনায় মুড়ি তৈরি এ অঞ্চলে শিল্পের রূপ নিয়েছে। বর্তমানে এই গ্রামগুলোর মুড়ি পাবনা, ঢাকা, নাটোর, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
পাবনা শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার মালঞ্চি ইউনিয়নের মাহমুদপুর, নতুনপাড়া, ঝবঝবিয়া, শ্যামপুর, বিলকুলা, গুপিনাথপুর, গুপিনপুর, ভবানীপুর, রাঘবপুর গ্রামগুলো এখন মুড়ি গ্রাম বলে পরিচিত।
সম্প্রতি ওই এলাকাগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেক বাড়িতে মুড়ি ভাজার ধুম পড়ে গেছে। বাড়িগুলোতে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধসহ সবাই মুড়ি উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
স্থানীয় প্রবীণদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের আগে এই গ্রামে প্রথম মুড়ি তৈরি শুরু করেন হাসান আলী নামের এক ব্যক্তি। সেই থেকে শুরু। এখনও সবাই বাপ-দাদার পেশা হিসেবে মুড়ি উৎপাদনকে ধরে রেখেছেন। মুড়ি তৈরি এখন মাহমুদপুরের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী আরও বেশ কয়েকটি গ্রামে।
মাহমুদপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চলছে মুড়ি তৈরির কাজ।
শ্যামপুরের আলী হোসেন জানান, শৈশব থেকেই তিনি মুড়ি তৈরি ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। গ্রামের পুরুষরা হাট থেকে ধান কেনা, ধান ভাঙানো, উৎপাদিত মুড়ি বাজারে বিক্রি এবং নারীরা ধান সিদ্ধ, শুকানো, মুড়ি তৈরিসহ নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন।
মুড়ি উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী মোহাম্মদ আলী, ওমর আলী, মোজাম উদ্দিন, আবদুল মতিন, হায়দার আলী, কামাল, রহিম শেখসহ অনেকের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, সারা বছর এই গ্রামগুলোতে মুড়ি ভাজা হয়। তবে রমজান মাস এলেই মুড়ি উৎপাদনের চাপ বেড়ে যায় অনেকগুণ।
মূলত স্বর্ণা, বিআর ১১, বিআর ২৯, আউশ ধান থেকে তারা মুড়ি তৈরি করেন। এর মধ্যে আউশ ধানের মুড়ির স্বাদ ভালো হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এক মণ ধান থেকে ২২-২৪ কেজি মুড়ি তৈরি হয়।
মুড়ি উৎপাদনকারী হাসিনা খাতুন বলেন, মুড়ি তৈরি করতে অন্তত দুজন দরকার হয়। আমরা লবণ পানি আর বালু দিয়ে মুড়ি ভাজি। বাজারে যে লম্বা ও সাদা মুড়ি পাওয়া যায় তা ইউরিয়া সার দিয়ে তৈরি হয়।
আবদুস সুবহান বলেন, নিজের বাড়িতে তৈরি ৪০ কেজির পাশাপাশি প্রতিদিন তাকে বাজারে দিতে হয় ১৬০ কেজি। বাজারে মুড়ির ঝালি মাপের অজুহাতে স্থানীয়দের বখরা দিতে হয় ৮ টাকা। খাজনা ৭ টাকা। গাড়িভাড়া প্রতি ঝালি ৩০ টাকা। মুড়ি তৈরির জন্য খোলা ধরতে একজন নারী শ্রমিককে দিতে হয় ৩০ টাকা আর দু’বেলা খেতেও দিতে হয়। ধান ভাঙাতে মিল মালিককে দিতে হয় প্রতি মণে ২০ টাকা। এক কেজি ধানের দাম পড়ে ২১ টাকা।
সকল খরচ বাদ দিয়ে প্রতি কেজি মুড়িতে ৫-৬ টাকা মুনাফা হয়। অর্থ্যাৎ এক মণ মুড়িতে তাদের হাতে লাভ থাকে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
মুড়ি উৎপাদনের জন্যই মাহমুদপুর এলাকায় তিনটি বৈদ্যুতিক ধান মাড়াইকল স্থাপিত হয়েছে।
মিলের মালিক কোবাদ আলী বিশ্বাস বলেন, বিদ্যুতের ভেল্কিবাজিতে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছি। ২৪ ঘণ্টায় ৭০০ থেকে ৮০০ মণ ধান ভাঙাতে পারি। কিন্তু বারবার বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে কোনো কাজ করতে পারছি না। ফলে মুড়ি উৎপাদনে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে।
পাবনা চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট সনি বিশ্বাস বলেন, রমজান মাসে ইফতারির তালিকায় অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে মুড়ি। কেমিকেলে প্রস্তুত মুড়ির ভিড়ে আসল মুড়ির স্বাদ পাওয়া যেন এখন কঠিন। মুড়ির আসল স্বাদ পেতে পাবনার মুড়ি গ্রামের হাতেভাজা মুড়ির জুড়ি নেই।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. আকসাদ আল মাসুর আনন বলেন, সাদা ও বড় হলেও ইউরিয়া পানিমিশ্রিত মুড়ি মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর। অথচ লবণ পানিমিশ্রিত মুড়ি মানবদেহের জন্য উপকারি।
পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর উপ-মহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, মাহমুদপুর গ্রামের মুড়ি তৈরির বিষয়টি আমাদের জানা রয়েছে। তারা কেমিকেলমুক্ত মুড়ি তৈরি করেন, এটা খুবই ভালো। এ সমস্ত কুটিরশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করার পরিকল্পনা আমাদের আছে। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সহজ শর্তে কিছু ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা পেতে পারেন।
নদী বন্দর / পিকে