দীর্ঘদিন ধরে চলা করোনা মহামারির মধ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভূমিদস্যুরা। বিশেষ করে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকায় নদী দখলদাররা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে, এই সুযোগে বাংলাদেশের প্রধান নদী মেঘনা এবং এর শাখা নদী ফুলদির একাংশ দখল করে শিপইয়ার্ড ও বহুতল ভবন স্থাপন করেছে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড নামের একটি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান।
নদী দখলের পরও তারা থেমে থাকেনি। ব্যক্তিগত জমি, এমনকি দুটি খালও দখল করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। রাতারাতি এসব কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনও শুরু করে দিয়েছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় সরেজমিন পরিদর্শন করে ঐ প্রতিষ্ঠানের জবরদখলের সত্যতা মিলেছে। প্রতিষ্ঠানটির দখল করা ভূমি উদ্ধারে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মেঘনা এবং এর শাখা নদী ফুলদির একাংশ দখল করে ভরাট করা হয়েছে। এ কারণে ফুলদি দিয়ে নৌ চলাচল হুমকির মুখে পড়েছে। এই নদী দিয়ে সরকারি খাদ্যগুদামে চালসহ বিভিন্ন স্থানে পণ্য সরবরাহ করা হয়। স্থানীয়রা জানান, থ্রি এঙ্গেল মেরিন লি. নদী দখলসহ দুটি খালও দখল করে নিয়েছে। অনেকের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল করে সেখান বালু ভরাট করা হয়েছে। কারখানা স্থাপনের ফলে আশপাশের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। ঐ এলাকার জমিতে আগে তিনটি ফসল হলেও এখন কৃষকরা মাত্র এক ফসল পাচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, থ্রি এঙ্গেল মধ্যকুমিরা ও বোরোচক নামের দুটি খাল ভরাট করে ফেলার কারণে ঐ এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা একেবারেই বিনষ্ট হয়েছে। খালের জায়গায় একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৬ সালের স্যাটেলাইট ছবিতে খাল দুটির অস্তিত্ব থাকলেও এখনকার ছবিতে তা নেই।
এদিকে ২০১৯ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন সেখানকার নদী দখলদারদের একটি তালিকা জাতীয় নদী কমিশনে পাঠিয়েছিল। সেখানে দখলদার হিসেবে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লি. এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকায় এক নম্বরে থাকা থ্রি এঙ্গেল মেঘনা ও ফুলদির একাংশ দখল করে নিয়েছে বলে সেখানে বলা হয়েছে।
গজারিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০১০ সালে প্রথমে উপজেলার দৌলতপুর এলাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন কয়েক বিঘা জমি কিনে নেয় থ্রি এঙ্গেল। কিন্তু গত দুই বছর ধরে হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রশাসনের লোকজন করোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে সুযোগটি নেয় তারা। এই সময়ের মধ্যে তারা নদী দখল করে তা ভরাট করতে শুরু করে। সরেজমিনে দেখে যায়, মেঘনা নদীর ৫০০ ফুটেরও বেশি দখল করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া ফুলদি নদীর অর্ধেক দখল করে তাতে বালু ভরাট করা হয়েছে।
এদিকে এলাকাবাসী এই নদী ভরাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত ৮ মার্চ উচ্চ আদালতে আপিল করে। হাইকোর্টের পক্ষ থেকে মুন্সীগঞ্জের ডিসি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) ওপর রুল জারি করা হয়। ঐ রুলে সরকারি ও বেসরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকে কেন তাদের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। পরবর্তী চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো পর্যন্ত সংশ্লিষ্টরা এর জবাব দেননি। আর এ সুযোগে দখল কার্যক্রম চালিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, শুধু নদী দখলই নয়, স্থানীয় জনগণের জমিও দখল করেছে থ্রি এঙ্গেল। এমনকি মৃত ব্যক্তির নামেও জমির দলিল করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নয়ানগর গ্রামের মঞ্জাল হক জানান, থ্রি এঙ্গেল তার ৩৭ শতাংশ জমি দখল করেছে। এখানে তার জমিতে তিন ফসল হতো। হঠাৎ করে তিনি দেখতে পান তার জমিতে বালু ভরাট হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে জানানো হয়, এই জমি তারা কিনে নিয়েছে তার মা সূর্যবান বিবির কাছ থেকে। ২০১১ সালে তার মা এই জমি তাদের রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। অথচ সূর্যবান বিবি ২০০৪ সালে মারা গেছেন। এরকম আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
এসব বিষয় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা লোকমান হোসেনের মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন। দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই নদী দখল করিনি। যদি দখল করে থাকি তা দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের। নদীর জমি পরিমাপ করলেই দেখা যাবে আমরা দখল করেছি কি না।’
ব্যক্তিগত জমি দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জমিজমা নিয়ে অনেক ভেজাল থাকে। এটা অনেক সময় দেখা সম্ভব হয় না। তবে জেনেশুনে আমরা কোনো ব্যক্তির জমি জবরদখল করিনি।’ আর খাল দখলের বিষয়ে লোকমান হোসেন বলেন, ‘এখানকার জমিগুলোর মধ্যে খালের কোনো রেকর্ড নেই।’
নদী বন্দর / বিএফ