চক্রটির সদস্যরা চড়তেন দামি গাড়িতে। পড়তেন দামি পোশাক। চলাফেরা করতেন অভিজাত সব জায়গায় অথবা হোটেলে। এভাবে প্রথমে ভিকটিমদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে চক্রটি। বিশ্বাস অর্জনের পর চক্রটি তাদের অনলাইনে এমএলএম সাইটে ১ হাজার ৮৫০ টাকা দিয়ে সদস্য হতে বলে। এ ক্ষেত্রে এই টাকা ১৫ অথবা ৩০ দিনে দিগুণ করার কথা বলে চক্রটি।
এর পরবর্তী ধাপে চক্রটি নতুন সদস্যদের বলে আরও নতুন সদস্য নিয়ে আসতে। প্রতিজন নতুন সদস্যের জন্য তারা ৫০ টাকা করে পাবেন। আর যে সদস্য ১৫০ জন নতুন সদস্য নিয়ে আসতে পারবেন তিনি হবেন স্টার সদস্য হবেন। আর এই স্টার সদস্যকে আইফোন, গাড়ি ও বিদেশে টুর্যের দেওয়ার প্রলোভন দেখাতো। এসব প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে ভুক্তভোগীরা হাজার হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন।
এভাবে চক্রটির অনলাইনভিত্তিক চারটি এমএলএম কোম্পানিতে ৫-৬ লাখ সদস্য সংগ্রহ করেন। এভাবে চক্রটি প্রায় ৪০-৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
ভুক্তভোগীদের এমন এসব অভিযোগের ভিত্তিতে চক্রটির সাত জন সদস্যকে শনিবার (১১ ডিসেম্বর) সাভারের আমিন বাজার থেকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এ সময় গ্রেফতারদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৯টি মোবাইল ফোন, ২০টি সিম কার্ড, একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেক বই, একাধিক ব্যাংকের এটিএম কার্ড, বিভিন্ন অবৈধ এমএলএম কোম্পানির বিজনেস প্লানের কাগজপত্র ও ৬২ হাজার টাকা জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেফতাররা হলেন- মো. আবুল হোসেন পুলক (৪০), মো. মাহাদী হাসান মল্লিক (৩৫), মো. মিজানুর রহমান ওরফে ব্রাভো মিজান (৫৫), মো. মহি উদ্দিন জামিল (৩৮), মো. সাইফুল ইসলাম আকন্দ (৪২), মো. কভেজ আলী সরকারভ (৩৫) ও মো. শাহানুর আলম শাহীন (৪২)।
রোববার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে মালিবাগে অবস্থিত সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সিআইডির ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন।
তিনি বলেন, চক্রটি প্রথমে একটি অনলাইন গ্রুপ খোলে তাদের ব্যবসার বিষয়ে প্রচারণা শুরু করে। চক্রটির সদস্যরা মানুষদের বলতো তাদের এখানে টাকা বিনিয়োগ করলে তারা ১৫ দিনে অথবা ৩০ দিনে তাদের টাকা দিগুণ করে দেবেন। মাত্র ১ হাজার ৮৫০ টাকা জমা দিয়ে তাদের কোম্পানির সদস্য হওয়া যাবে বলে চক্রটি প্রচারণা চালায়। চক্রটি সদস্যরা এভাবে প্রচারণা চালিয়ে সদস্য সংগ্রহের পাঁয়তারা করে। এছাড়া তারা সদস্যদের আকৃষ্ট করার সময় নিজেরা খুব বিলাসী জীবন যাপন করত। বিলাসী গাড়ি, বাড়ি এবং হোটেলে বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করত চক্রটির সদস্যরা। তখন আবার যারা বেশি সদস্য এনে দিতে পারতো ওইসব সদস্যদের বিভিন্ন রেটিং করে চক্রের সদস্যরা তাদের নিয়ে বিশাল বিশাল প্রোগ্রাম আয়োজন করত যেন আরও সদস্য আনা যায় এসব প্রোগ্রাম দেখিয়ে।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক সদস্যদের চক্রটি বলে আরও নতুন সদস্য নিয়ে আসতে। সে ক্ষেত্রে তারা প্রতি নতুন সদস্যের জন ৫০ টাকা করে পাবেন। আর দেড়শ’ জন সদস্য আনতে পারলে স্টার সদস্য হতে পারবে। আর এই স্টার সদস্যকে আইফোন, গাড়ি ও বিদেশে টুর্যের দেওয়ার প্রলোভন দেখাতো। এসব প্রলোভনে একেকজন ২-৩ হাজার নতুন সদস্য নিয়ে আসতে। আবার আরও বেশি সদস্য আনার জন্য কিছু কিছু স্টার সদস্যকে নিয়ে দেশ ও বিদেশে নানা প্রোগ্রাম আয়োজন করতো তারা।
অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন আরও বলেন, এই চক্রের হোতা হলেন আবুল হোসেন পুলক ও মাহাদী হাসান মল্লিক। তারা দুই জন ডেস্টিনিতে আগে কাজ করতো। ডেসটিনির থেকে এমএলএম ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে তারা এখন অনলাইনে এই প্রতারণা করে আসছেন। যদিও চক্রটির সদস্যরা এইটাকে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বলেন। সবাইকে মনে রাখতে হবে এক মাসে বা ১৫ দিনে কোনোভাবে টাকা দ্বিগুণ করা সম্ভব নয়। আমরা এই চক্রের প্রতারিত ভিকটিমদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছি যাদের অধিকাংশই নারী। তারা ঘরে বসে কিছু অর্থ আয় করার লোভে এই চক্রটি ফাঁদে পা দেয়।
সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, চক্রটির চারটি অনলাইন এমএলএম কোম্পানি আছে। চারটি কোম্পানির মাধ্যমে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় লাখ লোককে তারা প্রতারিত করেছে। এভাবে তারা ৪০-৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়ে টাকা এখন কোথায় আছে এবং এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলা সিআইডি বন্ধ করবে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করার এখতিয়ার আমাদের নেই, তবে আমরা এ বিষয়ে সুপারিশ করব। তারা ভিকটিমদের কাছ থেকে টাকাগুলো বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে নিয়েছে। প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া টাকার মধ্যে কিছু তারা বিনিয়োগ করেছে, আবার কিছু টাকা দিয়ে বিশাল বিশাল প্রোগ্রাম আয়োজন করতে খরচ করেছে। আর কিছু টাকা ব্যাংকে রেখেছে। তবে আসামিদের আজ আমরা রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠাবো। তাদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ পেলে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবো টাকাগুলো আসলে কোথায় তারা কিভাবে রেখেছে বা খরচ করেছে।
নদী বন্দর / জিকে