গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা এবং চিনি রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপের পর ভারতের পরবর্তী নিশানা হতে পারে চালের ওপর। দেশটির সরকার যেকোনো সময় চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। প্রথমে করোনাভাইরাস মহামারি, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে যে খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে, এর মধ্যে ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ বা সীমিত করলে বৈশ্বিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২৬ মে) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত ও মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে চাল রপ্তানি সীমিত করতে পারে ভারত সরকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার বরাতে সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পরিচালিত একটি কমিটি অ-বাসমতি চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছে এবং দাম বাড়ার লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
ভারতের ইয়েস ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ রাধিকা পিপলানি বলেছেন, ভারত সরকার এরই মধ্যে গম রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে। চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধের কথা বিবেচনা করা এখন সময়ে অপেক্ষা মাত্র। তবে এ ধরনের বিধিগুলো খাদ্যের দাম কমাবে কি না এবং তাতে কত সময় লাগবে সেটাই দেখার বিষয়।
চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপের সম্ভাবনার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের খাদ্য ও বাণিজ্য কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
চাল উৎপাদনে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় এবং রপ্তানিতে প্রথম। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি সুগন্ধি বাসমতি চাল রপ্তানি করেছিল মোট ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টন। একই সময়ে তাদের অ-বাসমতি চাল রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার টন।
দ্য ইকোনমিক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, ভারতে বর্তমানে চালের যথেষ্ট মজুত রয়েছে এবং দামও নিয়ন্ত্রণে। ভারতীয়দের খাদ্যতালিকা ও সরকারের খাদ্য রেশন ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত চাল। খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির জন্য ভারত সরকার আগের বছরের তুলনায় গম কেনা অর্ধেকে নামিয়ে চাল বেশি করে বিতরণের পরিকল্পনা করছে। এ কারণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেশীয়ভাবে কম দামে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থনীতিবিদ শার্লি মুস্তাফা বলেছেন, জনগণের মধ্যে বিতরণের জন্য পর্যাপ্তের চেয়ে বেশি চাল মজুত রয়েছে ভারত সরকারে হাতে, এমনকি গমের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে চালের রেশন বাড়ানোর পরেও।
গত কয়েক মাস বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের মধ্যেও বিশ্ববাজারে চালের দাম প্রায় স্থিতিশীলই ছিল বলা যায়। তবে ভারত চাল রপ্তানি কমিয়ে দিলে সেই পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে পারে। এমনকি সেটি অন্য দেশগুলোকেও চাল রপ্তানি সীমিত করতে উৎসাহিত করতে পারে।
ভারতের চাল রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি বিভি কৃষ্ণা রাও বলেন, দেশে চালের সরবরাহ যথেষ্ট রয়েছে। এ অবস্থায় রপ্তানি নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। সরকার যদি এখনো কোনো পরিমাণগত বিধিনিষেধ আরোপ করতে চায়, তবে সেটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে এবং এটিকে জাতীয় স্বার্থে স্বাগত জানাবে ব্যবসায়ীরা।
অবশ্য ভারত সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুই কর্মকর্তার বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন বলেছে, এই মুহূর্তে দেশটির চাল রপ্তানি নিষিদ্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই। এ ধরনের খবরগুলোকে গুজব বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
এর আগে দেশীয় বাজারে দাম কমানোর লক্ষ্যে গত ১৩ মে গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করে ভারত। দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গম উৎপাদক হলেও বৈশ্বিক রপ্তানিতে তাদের অংশ মাত্র এক শতাংশের মতো। পরিমাণ ও মূল্য উভয় দিক থেকে ভারতীয় গমের সবচেয়ে বড় ক্রেতা বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতের মোট গম রপ্তানির ৫৪ শতাংশই এসেছে বাংলাদেশে। ওই বছর ভারতীয় গমের শীর্ষ ১০ ক্রেতা ছিল বাংলাদেশ, নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, শ্রীলঙ্কা, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, কাতার, ইন্দোনেশিয়া, ওমান ও মালয়েশিয়া।
তবে বাংলাদেশের জন্য আশার কথা, প্রতিবেশী ও খাদ্য সংকটের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে গম রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত রেখেছে ভারত।
এছাড়া, আগামী ১ জুন থেকে চিনি রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে ভারত সরকার। গত ২৪ মে ভারতীয় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বছর দেশটি চিনি রপ্তানির সীমা এক কোটি টন নির্ধারণের পরিকল্পনা নিয়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম চিনি উৎপাদক ভারত, রপ্তানিতে তাদের অবস্থান কেবল ব্রাজিলের পেছনে। বিশ্বের অন্তত ১২১টি দেশে চিনি রপ্তানি করে ভারতীয়রা। এক্ষেত্রে তাদের প্রধান ক্রেতা ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, সুদান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো।
নদী বন্দর/এসএফ