পৈতৃক সম্পত্তি ছিল এক বিঘা জমি। তাতে ধান চাষ করলে থাকতো সবজির অপূর্ণতা। আবার সবজি চাষ করলে জুটতো না দু’বেলা দু’মুঠো ভাত বছরজুড়ে। এমন অভাবের পরিস্থিতিই তাকে বাধ্য করে একখণ্ড জমি থেকে বেশি ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে। এই লক্ষ্যেই আড়াই যুগের পরিশ্রম আর একাগ্রতা আজ তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। ‘অভাবই আমাকে শিখিয়েছে অভাব তাড়ানোর মন্ত্র’ গর্বের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে এ কথা বলা মানুষটির নাম জাহিদুল ইসলাম।
তিনি নিজের জমিতে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন বিদেশি ফলের গাছের নার্সারি। এখন ১৮ বিঘা জমির এক বিশাল চারা ও নতুন নতুন জাতের ফলের সাম্রাজ্য তার। চারা ও ফল বিক্রি করে প্রতিবছর তার আয় প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার গুমানিগঞ্জ ইউনিয়নের কুষ্ণপুর ছয়ঘড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ৫০ বছর বয়সী এই মানুষটির নার্সারিতে কাজ করে অভাব ঘুচিয়েছে আরও অনেক পরিবার। তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ওই এলাকার আরও অনেক নার্সারি গড়ে ওঠায় ইতোমধ্যে এই গ্রামটি নার্সারি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমানে ওই এলাকার শতাধিক বিঘা জমিতে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত নার্সারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্ত্রীর নামে নামকরণ করা নার্গিস নার্সারির মালিক জাহিদুল ইসলাম জানান, তার বা ওই গ্রামের নার্সারির নতুন জাতের ফলন্ত চারা ছাড়া রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় বৃক্ষমেলা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় না। বিদেশি উন্নতজাতের জাপানি মিয়াজাকি, কিং অব চাকাপাত, চাইনিজ চ্যাঙমাই, আমেরিকান পালমার, ব্রুনাইয়ের ব্রুনাই কিংসহ ১০-১২টি নতুন প্রজাতির আমের সঙ্গে এবার তার নার্সারিতে ফলেছে সৌদি জাতের খেজুর। এ বছর নার্সারির চারা গাছে উৎপাদিত শুধু নতুন জাতের আমই বিক্রির লক্ষ্য ধরেছেন তিনি ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রাম কুষ্ণপুর ছয়ঘড়িয়া গ্রামে গিয়ে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে এ খেজুর উৎপাদনের কথা জানা গেলেও রংপুর বিভাগে জাহিদুল ইসলামের নার্সারিতেই প্রথম এ খেজুর ফলেছে বলে তিনি দাবি করেন।
জাহিদুল ইসলাম জানান, আড়াই যুগেরও বেশি সময় ধরে নতুন নতুন জাতের নানা প্রকার ফলের চারা ও ফল উৎপাদনের অংশ হিসেবেই তিনি ১০ বছর আগে আজওয়া, বারিহি, সুপকারি, বড়াইসহ কয়েকটি প্রজাতির খেজুরের বীজ রোপণ করেন। বস্তার বেডে লাগানো চারাগুলোতে ৯ বছরেও ফুল না আসায় গত বছর তিনি ওই ২৫০টি চারা তুলে মাটিতে নতুন করে রোপণ করেন। এ বছরের মধ্যে ১২টি চারায় ফুল আসে। পাশাপাশি প্রায় সব চারার গোড়া থেকেই পার্শ্বচারা বের হয় বেশ কয়েকটি করে।
বর্তমানে তিনি পার্শ্বচারাগুলো বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন। বীজের চারার চেয়ে উন্নতমানের এসব পার্শ্বচারায় নিশ্চিতভাবে খেজুর ফলবে বলে তিনি আশাবাদী। ছোট ছোট এবং গোলাকৃতির সবুজ খেজুরের ভারে নুইয়ে পড়া ৫-৬টি গাছের সৌদী খেজুর দেখতে এখন প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছে বলে তিনি জানান।
তার আম এবং মিশ্র ফলের চারার নার্সারিতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের প্রায় সহস্রাধিক আমের চারায় বিভিন্ন রঙে রঙিন বিচিত্র দর্শনের অসংখ্য আম ফলে আছে। পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষায় কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের বদলে স্বাস্থসম্মত প্যাকেট দিয়ে ঢেকে রেখেছেন অধিকাংশ আম। এর মধ্যে রয়েছে সবচাইতে দামি আম হিসেবে খ্যাত জাপানি মিয়াজাকি বা সূর্য্যডিম, প্রায় ২ কেজি ওজনের ব্রুনাই কিং, পাকা কলার মতো আকার ও রঙের থাই বানানা জাতেরসহ বিভিন্ন প্রজাতির আমের ভারে প্রতিটি চারা গাছেরই নুইয়ে পড়া অবস্থা।
তিনি জানান, প্রতিটি চারায় ৫-৭টি করে ঝুলন্ত আমসহ এসব চারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে কিনে নিয়ে যান পাইকাররা। বর্তমানে জাত এবং প্রকারভেদে প্রতিটি চারা ৩শ’ থেকে ৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে। কিছুটা বড় চারা গাছ থেকে প্রথমে সায়ান (চারা তৈরির জন্য গাছের ছোট ডাল), এরপর ফল এবং শেষে চারা বিক্রি করা হয়। নার্সারি পণ্য হিসেবে একটি চারার বহুমুখী ব্যবহারের ফলে তাদের কয়েক গুণ বেশি আয় হয়।
এখানকার সব নার্সারি মালিকই এখন এ পদ্ধতিতেই ব্যবসা করছেন। একমাত্র ছেলে নাসিমুল ইসলাম, ১৫ থেকে ২০ জন কর্মচারী ও নিজে ৬টি নার্সারিতে দিনরাত কাজ করে তিনি এখন স্বচ্ছল ও সফল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
নার্গিস নার্সারির কর্মী সজিব মিয়া বলেন, আমিসহ এ নার্সারিতে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ সারাবছর কাজ করে আমাদের সংসার চালাতে পারছি। এলাকায় কোনো মানুষ আর বেকার নাই এখন।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রেজা-ই-মাহমুদ বলেন, প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ী এবং আধুনিক চাষি জাহিদুল ইসলাম এখন ওই এলাকার নার্সারি পেশার মানুষের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাকেসহ সব নার্সারি মালিককে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।’
নদী বন্দর/এসএফ