পরম যত্নে যিনি সারা জীবন অন্যের ‘শেষ ঠিকানা’ তৈরি করে দিয়েছেন, সেই মানুষটি নিজেই পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে। ‘শেষ ঠিকানার নিপুণ কারিগর’ কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. মনু মিয়া (৬৭)। জীবদ্দশায় ৪৯ বছরে ৩ হাজার ৫৭টি কবর খুঁড়েছেন তিনি। এবার তার মৃত্যুর পর কবর খুঁড়লেন তারই ছয়জন শিষ্য।
গত শনিবার (২৮ জুন) বিকেলে আছরের নামাজের পর জয়সিদ্ধি গোরস্থান-সংলগ্ন মাঠে জানাজা শেষে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
মনু মিয়ার জন্য কবর খুঁড়েছেন—জয়সিদ্দি ইউনিয়নের আলগা পাড়া গ্ৰামের ইয়াছিন মিয়া (৫৫), সবর আলীর ছেলে মো. রমজান (৬০), করিম মোল্লার ছেলে নিয়ামল মোল্লা (৩০), মৃত তাজুল ইসলামের ছেলে মো. রওশন চৌধুরী (৩৫), সুরুজ মিয়ার ছেলে অপু (৩২) ও গফুর মিয়া (৪৫)।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একজন নিখুঁত ও সুদক্ষ গোরখোদক হিসেবে দুর্গম হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে মনু মিয়ার সুনাম রয়েছে। রাজধানীর বনানী কবরস্থানসহ দেশের নানা প্রান্তে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৭টি কবর খনন করেছেন তিনি। কোথাও বেড়াতে গিয়ে যদি কারো মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছেন তো তিনি সেখানে ছুটে গিয়ে কবর খননে সামিল হয়েছেন। এমনো হয়েছে, ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় তিনি বিছানা ছেড়ে ওঠতে পারছেন না। কিন্তু কারো মৃত্যুর সংবাদ তার কানে আসতেই তিনি কবরস্থানে ছুটে গিয়ে তার কবর খনন করেছেন।
তারা আরও জানান, পরম যত্ন আর অপার ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করা হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের শেষ আশ্রয়স্থল ‘কবর’। মানুষের শেষ বিদায়ের একান্ত সঙ্গী হয়ে সাদা কাপড় পরানো থেকে শুরু করে আতর-গোলাপ মাখিয়ে কবরে মাটি দেওয়া অবধি পাশে থাকতেন মনু মিয়া। কোনো ধরনের পারিশ্রমিক কিংবা বখশিস না নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কবর খুঁড়ে গেছেন।
জানা যায়, দুই ভাই ও তিন বোনের সংসারে মনু মিয়া ছিলেন তৃতীয়। কবর খোঁড়ার কাজে বাহন হিসেবে এ পর্যন্ত তিনি চৌদ্দটি ঘোড়াও কিনেছেন। আর এ জন্য বিক্রি করতে হয়েছে তার পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি। পৈত্রিক অন্য সম্পত্তি বন্ধক দিয়েই চলছিল নিঃসন্তান মনু মিয়ার সংসার ও কবর খোঁড়ার কাজ। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কবর খোঁড়ার কাজ করতে খুন্তি-কোদাল, দা, চাকু, স্কেল আর করাত ইত্যাদি ভর্তি বস্তাসহ হাওরের বন্ধুর পথে ঘোড়ায় চড়ে পৌঁছে যেতেন তিনি।
মনু মিয়ার কবর খোঁড়ার দীর্ঘদিনের সহকর্মী ছিলেন ইয়াছিন মিয়া। তিনি বলেন, আমি প্রায় দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে ওনার সঙ্গে কাজ করছি, ওনার কাছ থেকেই কবর খোঁড়ার কাজ শিখেছি। নিজের হাতে বিদায় জানাতে খুব কষ্ট হয়েছে আমাদের। কবরের কাজ করতে গিয়ে কেমন খারাপ লেগেছে—এটা আপনাদের বুঝাতে পারবো না। আমাদের মন মানতে ছিল না আমাদের মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছে। যিনি পরম যত্নে কবর খোঁড়ার কাজ করতেন, আর যখন তার কবর খুঁড়ছি, তখন চোখ দিয়ে পানি পড়েছে। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুক।
মো. রমজান (৬০) নামে আরও একজন বলেন, আজকে যারা কবর খুঁড়েছি সবাই আমার ভাইয়ের (মনু মিয়া) কাছ থেকে শিখেছি। আমার ভাইয়ের দা, কুন্তি, কোদাল দিয়েই তার কবর খোঁড়ার কাজ করেছি। যেখানেই মৃত্যুর খবর পেয়েছেন আমার ভাই সেখানেই ছুটে গেছেন।
মনু মিয়ার প্রতিবেশি নিয়ামল মোল্লা বলেন, যখনই দেখেছি বাড়ি থেকে ঘোড়া নিয়ে বের হয়েছেন, তখনই বুঝেছি কোথাও হয়তো কেউ মারা গিয়েছেন। সেজন্য হয়তো ছুটে যাচ্ছেন সেখানে, এটা আমাদের এলাকার সবাই বুঝতো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে ইব্রাহিম নামে একজন লেখেন, গোরখোদক মনু মিয়া জীবনে কবর খুঁড়েছেন ৩০০০+। তার জানাজায় এস্টিমেটেড মানুষ ছিল ৫০ হাজারের মতো। শিক্ষা বা টাকায় আমার অবস্থান মনু মিয়া থেকে অনেক উপরে। আমি বুকে হাত দিয়া বলতে পারি, আমার জানাজায় ৫০০ লোক আসবেই আসবে—এই কথাটা আমি কনফিডেন্টলি বলার সাহস রাখি না। আমি? না মনু মিয়া—কে যে আসলে জীবনে জিতলাম, বুঝতে পারতেসি না।
মনু মিয়ার ভাতিজা শফিকুল ইসলাম বলেন, তার চাচা দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুর ছয় দিন আগে চিকিৎসা শেষে ইটনার বাড়িতে ফিরে আসেন। গত শনিবার সকালে তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মারা যান। তিনি বলেন, আমার চাচা (মনু মিয়া) কবর খোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মৃত্যুর দিন-তারিখ ডায়েরিতে টুকে রাখতেন। তার ডায়েরি অনুযায়ী, তিনি মোট ৩ হাজার ৫৭টি কবর খুঁড়েছেন।
তিনি আরও বলেন, কবর খুঁড়তে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য কয়েক বছর আগে কৃষি জমি বিক্রি করে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন চাচা। এই ঘোড়াই তাকে কর্মচঞ্চল রেখেছিল। একসময় দুর্বৃত্তরা তার ঘোড়াটিকে মেরে ফেলে। এ খবর গণমাধ্যমে আসার পর দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে তাকে ঘোড়াসহ নানা সহায়তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মনু মিয়া কারো সাহায্য নিতে রাজি হননি। তিনি কেবল নিজের সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছিলেন, যাতে আবারও অন্যের জন্য কবর খুঁড়তে পারেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মনির উদ্দিন বলেন, একজন সুদক্ষ গোরখোদক হিসেবে মনু মিয়ার সুনাম ইটনা, মিঠামইন, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জসহ পাশের হাওর উপজেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি ঢাকার বনানী কবরস্থানসহ দেশের নানা প্রান্তেও তার কবর খোঁড়ার সুনাম ছিল।
তিনি আরও বলেন, মনু মিয়া সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। বর্তমানে এমন মানুষ পাওয়া বিরল। মনু মিয়া শুধু কবর খনন করেই ক্ষান্ত হতেন না, এ পর্যন্ত যাদের কবর খুঁড়েছেন তিনি, তাদের মৃত্যুর দিন-তারিখ সব লিখে রাখতেন নিজের ডায়েরিতে। তার মৃত্যুর খবরে এখনও এলাকাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করে।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ মে মনু মিয়া অসুস্থ হন। এরপর ঢাকায় একটি হাসপাতালে ভর্তি হলে সংকটকালেই বর্বরতার বলি হয়েছে তার প্রিয় ঘোড়াটি। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দেশের সব গণমাধ্যমে উঠে আসে মনু মিয়ার জিবন কাহিনি। বাড়িতে মনু মিয়া ও তার স্ত্রী রহিমা বেগমের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে ঘোড়াটি। এরপর ঘোড়াটি হারিয়ে যায়। গ্রামের কারো নজরে পড়েনি মনু মিয়ার সেই প্রিয় ঘোড়াটি। তিন দিন পর পার্শ্ববর্তী মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের হাশিমপুর ছত্রিশ গ্রাম থেকে গ্রামবাসীর কাছে একটি ফোনকলে আসে এ দুঃসংবাদটি। হাশিমপুর ছত্রিশ গ্রামের একটি মাদরাসার পাশের জমির পানির মধ্যে ঘোড়াটির মরদেহ পড়ে রয়েছে। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান আলগাপাড়া গ্রামের তিন যুবক। তারা গিয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকা ঘোড়াটিকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যান। বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। সে সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনু মিয়ার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কথা ভেবে স্ত্রী ও স্বজনরা তার কাছে গোপন রেখেছেন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া তার ঘোড়াটির কথা। মনু মিয়া কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে জানতে পারেন তার চলার পথের প্রিয় সঙ্গীটি আর নেই। সে সময় অনেকেই তাকে নতুন করে ঘোড়া কিনে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি আর গ্রহণ করেননি। হয়তো সেই কষ্টের সমাপ্তি ঘটেছে মনু মিয়ার মৃত্যুর মাধ্যমে।
নদীবন্দর/জেএস