সিলেট অঞ্চলের দীর্ঘতম নদী সুরমায় জেগেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। এ সব চরে খেলছে বালকেরা। কোথাও আবার রোপণ করা হয়েছে সবজি। কোথাও তৈরি হয়েছে হেঁটে চলার পথ। অনেক স্থানে হাঁটুজল থাকায় হেঁটে নদী পার হচ্ছেন অনেকে।
অনেক স্থানে নদী সরু নালার মতো হয়ে গেছে। এতে নাব্য সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে পণ্যবাহী নৌযান (বলগেড) চলাচল। এ সব যান আটকে আছে চরে। ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল করলেও পানির গভীরতা কম থাকায় ডুবোচরে আটকে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগছে কয়েকগুণ।
সুরমা নদীর কানাইঘাট উপজেলা অংশের কিছু এলাকা সরেজমিন ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। একই দৃশ্য দেখা গেছে, সিলেট নগরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া অংশেও। নগরের কুশিঘাট থেকে কাজীর বাজার সেতু হয়ে টুকেরবাজার তেমুখী পর্যন্ত নদীর বিভিন্নস্থানে পলি জমে জেগে উঠেছে চর। এই অংশে নাব্য সংকটের পাশাপাশি নদীতে আর্বজনা ফেলার কারণে পানির রঙেও এসেছে পরিবর্তন। কালচে রঙ ধারণ করা নদীর পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
নদীতীরের বাসিন্দারা জানান, এক সময় সারা বছর নদীতে বড় নৌযান চলাচল করতো; পণ্য পরিবহন করা হতো এসব নৌযানে। এখন বছরের অর্ধেক সময় নদীতে পানি থাকে না। তখন স্রোতস্বিনী সুরমা সরু খালে পরিণত হয়। পানির গভীরতা এতটা কমে যায় যে, হেঁটে নদী পারাপার করা যায়।
তারা আরও জানান, প্রতি বছর সুরমা নদীতে নতুন চর জাগছে। তবে এ বছর পানি প্রবাহ অনেক কমেছে। গত বছর নদীর যেই অংশে পানি ছিল, এ বছর সেই অংশেও পানি নেই। যে কারণে শীতকালীন সবজি এবং বোরো ধান চাষে কৃষকদের অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছে। একইসঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাওয়ায় খাবার পানির সংকট দেখা দিচ্ছে বলে জানান তারা।
চর জাগার কারণে নদীর গভীরতা কমে গেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নাব্য হারিয়েছে সুরমা। পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে নদীর দুই তীর উপচে পানি প্রবাহিত হয়ে অকাল বন্যার দেখা দেয়। তখন নদী ভাঙনও প্রকট আকার ধারণ করে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক ও সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আব্দুল করিম কিম বলেন, বরাক নদীর মোহনায় সুরমার উৎসমুখে চর জাগায় পানির পুরোটাই কুশিয়ারা নদীতে প্রবাহিত হয়। এতে সুরমার পানির প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তা লোভাছড়াসহ বিভিন্ন উপনদীর। তাই নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে উৎসমুখ থেকে লোভাছড়ার মোহনা পর্যন্ত খনন করা জরুরি।
সেভ দ্য হ্যারিটেজ এর প্রতিষ্ঠাতা গবেষক আবদুল হাই আল হাদী বলেন, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং শাখা নদী ও খালবিলের রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সুরমা মৃতপ্রায় হয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে উৎসমুখসহ নদী খননের মাধ্যমে নাব্য সংকট দূর করে সুরমাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়া দরকার। না হলে এক সময়ের স্রোতস্বিনী এ নদী ধ্বংস হয়ে যাবে।
ভারতের মনিপুর রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি বরাক নদী সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসিদ এলাকায় সুরমা ও কুশিয়ারা নাম ধারণ করে বাংলাদেশ প্রবেশ করে। এর মধ্যে ২৪৯ কিলোমিটারের সুরমা নদী জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ, সিলেট সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ শহর ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলা হয়ে ভৈরবের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
পাউবো সূত্র জানায়, সুরমা নদীর উৎসমুখ থেকে ২৬ কিলোমিটার অভিন্ন সীমান্ত নদী হিসেবে চিহ্নিত। এজন্য এককভাবে কোনো দেশের পক্ষে নদী খনন করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। সচিব পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে নদীর উৎসমুখ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে জরিপে আটকে আছে সেই উদ্যোগ।
অবশ্য ২০১৮ সালে সিলেট সদর উপজেলার কানিশাইলে ৬০০ মিটার সুরমা নদী খনন করা হয়। এ সময় সিলেট সদর উপজেলা এবং কানাইঘাট উপজেলার কয়েকটি অংশে নদী খননের জন্য প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুজ্জামান সরকার জানান, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি প্রবাহ কমে যায়, এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। নাব্য সংকটের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখছে। আপাতত সুরমা খননের প্রকল্প নেই বলে জানান তিনি।
নদী বন্দর / এমকে