মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে পানি সরবরাহের জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। মোহরা পানি শোধনাগার ফেস-২ নামে দৈনিক ১৪ হাজার কোটি লিটার উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া প্রকল্পের জন্য বিবিধ খাতে ব্যয়ের জন্য আরও প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বাজেট করা হয়েছে বলে জানা যায়।
ওয়াসার ওই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইটিএ) যাচাইয়ের দায়িত্ব পড়ে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) ওপর। তারা বেশ কিছুদিন নতুন এই প্রকল্প ঘিরে হালদা নদীর পরিবেশগত প্রভাব যাচাই করে। পরে ১৮৪ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি। তাদের সেই প্রতিবেদনে হালদার পরিবেশগত কোনো সমস্যা না থাকায় ছাড়পত্রের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে পাঠায় ওয়াসা।
এরপর প্রতিবেদনটির ওপর গত বছরের নভেম্বরে পরিবেশ অধিদফতর কার্যালয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন হালদা নদী নিয়ে কাজ করা একাধিক গবেষক। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হলে সেই প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি তোলেন কয়েকজন হালদা বিশেষজ্ঞ।
তারা বলেন, আইডব্লিউএমর তৈরি করা রিপোর্ট মূলত আগের রিপোর্টের কপি। নতুন করে নদীতে কোনো সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়নি। আবার রিপোর্ট তৈরিতে ছিলেন না কোনো বিশেষজ্ঞ। তাই তড়িঘড়ি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে মনগড়া প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে বলে একাধিক বিশেষজ্ঞ অভিযোগ করেন।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মনজুরুল কিবরিয়া। তিনি তার বক্তব্যে প্রতিবেদনটির ১৩ পয়েন্টে দ্বিমত পোষণ করে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিরোধিতা করেন। সেমিনারে তার দেয়া যুক্তি হলো- হালদা নদী থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রস্তাবিত প্রকল্পসহ প্রতিদিন ৫৬.১ কোটি লিটার পানি উত্তোলনের পরও রিপোর্টে দেখানো হয়েছে ২.০৫ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হবে। অথচ ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক চট্টগ্রামের একটি দৈনিকে ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর তারিখের সাক্ষাৎকারে নিজে বলেন ৩.৫ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হবে। আবার আইডব্লিউএমর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী হালদার মোহরা অংশে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পানি দেখানো হয়েছে ১৬০০-২১৫০ এমএলডি (মিলিয়ন অব লিটার পার ডে) যার গড় পরিমাণ ১৮৭৫ এমএলডি। একই সময়ে নদী থেকে পানি উত্তোলন করা হবে ৫৬১ এমএলডি। ঐকিক নিয়মে নদী থেকে পানি উত্তোলনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯.৯২ শতাংশ। অর্থাৎ নদীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পানি উত্তোলন করা হবে।
যদিও আইডব্লিউএমর বক্তব্য হচ্ছে- হালদায় পানি কমে গেলে বাকি পানি কর্ণফুলী নদী থেকে পূরণ করা হবে এবং হালদায় মাছ ডিম ছাড়ে বর্ষাকালে। এমন বক্তব্যের যুক্তিতে ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘হালদায় বর্ষাকালে মাছ ডিম ছাড়লেও ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস হলো মাছের প্রজননের পূর্ববর্তী সময় বা প্রি স্পনিং টাইম। এমন সময় মাছের গুণগত মানের পানি ও প্রচুর পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন হয়। এ সময় পানির সংকট হলে কিংবা কর্ণফুলী থেকে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে হালদার জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হবে।’
আবার আইডব্লিউএমর রিপোর্টে বলা হয়েছে- হালদা থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন করা হলেও মাছের স্বাভাবিক প্রজননে সমস্যা হবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ড. মনজুর বলেন, ‘কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিংবা তথ্য-উপাত্ত ছাড়া এমন বক্তব্য দেয়া হয়েছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়নি কী পরিমাণ পানি থাকলে হালদা প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের উপযুক্ত থাকবে। আবার স্তন্যপায়ী প্রাণী ডলফিনের জন্য কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন তার কিছুই প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। শুধু বাজার থেকে মাছের ছবি তুলে দিয়ে বলা হয়েছে মাছের প্রজননের কোনো সমস্যা হবে না। অথচ হালদার কোনো মাছ বাজারে পাওয়া যায় না।’
জানা যায়, পরিবেশ অধিদফতরে সেমিনারের পর ড. মনজুরুল কিবরিয়া জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে একটি আবেদন করেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪ নভেম্বর নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদারের সভাপতিত্বে আরেকটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আলোচনায় অংশ নেন পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক, চট্টগ্রাম ওয়াসার মহাব্যবস্থাপক, হালদা বিশেষজ্ঞ ড. মনজুরুল কিবরিয়া, আইডব্লিউএমর প্রতিনিধি, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকসহ সরকারের বেশ কয়েকজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওই আলোচনা সভার প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, আলোচনায় অংশ নেয়া অধিকাংশের মতামত হচ্ছে, হালদার স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট করে নতুন করে কোনো প্রকল্প স্থাপন করা সমীচীন হবে না। তারা হালদার প্রকল্পটি নিয়ে আরও যাচাই-বাছাইয়ের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বিকল্প উৎস থেকে পানি উত্তোলন করা যায় কী না দেখতে বলা হয়েছে।
এদিকে হালদা নিয়ে সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের পরিচালিত অভিযানের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই সময়ে হালদা থেকে ২৬৮ কিলোমিটার সমান লম্বা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল উদ্ধার করা হয়। যা পুরো হালদা নদীর দৈর্ঘের আড়াই গুণেরও বেশি। একই সময়ে উপজেলা প্রশাসন পরিচালিত ১৫৮ ভ্রাম্যমাণ আদালতে ধ্বংস করা হয় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত ৫০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা, জব্দ করা হয় ১ লাখ ১৫ হাজার ঘনফুট বালু। এসব অভিযানে ধ্বংস করা হয় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত সাড়ে তিন কিলোমিটার লম্বা সমান পাইপ এবং জাল বসানোর কাজে ব্যবহৃত নৌকা জব্দ করা হয় পাঁচটি। একইসঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয় ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা এবং তিনজনকে দেয়া হয় একমাসের কারাদণ্ড।
এছাড়া হালদা দূষণের দায়ে পরিবেশ অধিদফতর ও হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট ও এশিয়ান পেপার মিল। আবার নিলামে বালু বিক্রি থেকে উপজেলা প্রশাসনের আয় হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এর বাইরে রাউজান উপজেলা প্রশাসন ও নৌ পুলিশের উদ্যোগেও পরিচালিত হয়েছে একাধিক অভিযান।
এ বিষয়ে ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘সরকার গেজেট প্রকাশ করে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করেছেন। ওই গেজেট বলা আছে, হালদাতে কোনো সেচ প্রকল্প স্থাপন, নতুন পানি শোধনাগার, কিংবা পানি উত্তোলনসহ সার্বিক বিষয়ে হেরিটেজ কমিটির মতামত নিতে। এছাড়া নদীতে কোনো প্রকল্প স্থাপন করতে হলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের মতামত লাগে। কিন্তু হালদাতে নতুন করে ওয়াসার প্রকল্প স্থাপন নিয়ে কারও সঙ্গে মতবিনিময় করেনি আইডব্লিউএম। তারা গোপনে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এটাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছেন। আমরাও ওয়াসাকে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে পানি সরবরাহের বিকল্প উৎসের কথা বলেছি। তারা চাইলে কর্ণফুলী নদী, ফেনী নদী, ডাকাতিয়া নদী, মিরসরাই লেক, কাপ্তাই লেক কিংবা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পানি সরবরাহ করতে পারে। আবার মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মতো সমুদ্রের পানিকে লবণমুক্ত করে ব্যবহার করতে পারে। শুধু পানি উত্তোলনের জন্য জাতীয় সম্পদ হালদা ধ্বংস হতে দেয়া যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমনিতে স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বালু উত্তোলন, মাছ আহরণ করে হালদার স্বাভাবিক পরিবেশ বিপর্যয় করছে। প্রায়ই হালদা থেকে নিষিদ্ধ জাল উদ্ধার করা হচ্ছে। আবার বালু উত্তোলনে ইঞ্জিনচালিত নৌকাও ধ্বংস করা হচ্ছে। এসবের পর ওয়াসার মতো দায়িত্বশীল জায়গা থেকে নতুন করে পানি উত্তোলন প্রকল্প বসিয়ে হালদার জীববৈচিত্র বিনষ্টের চেষ্টা কাম্য নয়। আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও যাচাই-বাছাই করে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে সরে আসার অনুরোধ করছি।’
জানতে চাইলে আইডব্লিউএমর নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খান বলেন, ‘আমরা পর্যাপ্ত গবেষণা করে ১৮৪ পৃষ্ঠার একটা খসড়া প্রতিবেদন দিয়েছিলাম। এখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিচ্ছি। আমাদের গবেষণায় যা আসছে আমরা তাই দিয়েছি। গ্রহণ করা না করা ওয়াসার বিষয়। আপনি একটু ওয়াসা থেকে জেনে নিয়েন। আর একটা গবেষণার পক্ষে-বিপক্ষে অনেকেই থাকে।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘হালদা থেকে পানি উত্তোলনে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। এ বিষয়ে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গবেষণা আছে। এখন কেউ যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিরোধিতা করে সেটা ভিন্ন কথা। এই প্রকল্প এখনো পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র দেয় নাই। তাছাড়া এটা নিয়ে এখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বাস্তবায়ন করা হবে। না হয় সরকার যেভাবে বলে সেভাবেই করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে বিকল্প যে নদীগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেগুলোর অধিকাংশ ভারতে উৎপত্তি। শুকনো মৌসুমে ভারত বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রাখে। ফলে ওই সময়ে নদী থেকে পানি পাওয়া যাবে না। তাই হালদাকে নির্বাচন করা হয়েছিল। তাছাড়া মিরসরাইয়ে ওই শিল্পাঞ্চলে পানি লাগবে দৈনিক ১০০ কোটি লিটার। হালদা থেকে উত্তোলন করা হবে মাত্র ১৪ কোটি লিটার। বাকি পানি তো অন্যান্য উৎস থেকে নেয়া হবে। বাংলাদেশের আইনে বলা আছে, খাবার পানি আগে, তারপর চাষাবাদসহ অন্যান্য কাজের জন্য চিন্তা। সুতরাং এদিক দিয়ে হলেও হালদা থেকে পানি উত্তোলন করা যায়।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, ‘হালদা থেকে পানি উত্তোলন করা হলে মাছের স্বাভাবিক প্রজননের কোনো সমস্যা হবে কী না- এটা আমার কাছে অফিসিয়ালি কেউ জানতে চায়নি। এ বিষয়ে আমরা কোনো সমীক্ষাও পরিচালনা করিনি। তাই আমি কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।’
নদী বন্দর / পিকে