শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে নলকূপ থেকে পানি ওঠানোর চেষ্টা করছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব রাবেয়া বেগম। বার বার চেষ্টা করে পানি তুলতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। তীব্র ক্ষোভ ঝাড়ছেন নলকূপের ওপর।
খুলনার টুটপাড়া ঘোষেরভিটা এলাকার একটি নলকূপ থেকে তাকে সোমবার (২২ মার্চ) সকালে পানি ওঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে দেখা যায়। রাবেয়া বেগম বলেন, এই কলটায় প্রতিদিন এক দেড়শ মানুষ পানি নিতে আসে। কিন্তু প্রায় এক মাস ধরে আমরা পানি ওঠাতে পারছি না।
বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহ করা এই নারী বলেন, পরের বাসায় পানি দেব কি! নিজের বাসার জন্যও পানি নিতে পারছি না।
তিনি প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ওয়াসার পানিও ঠিকমতো পাই না। কখন পানি যায় আর কখন আসে তা বলা মুশকিল। করোনার কারণে এখন কারো বাড়ির মধ্যে গিয়ে পানি আনা অসম্ভব।
একই নলকূপে পানি নিতে আসা তাসলিমা জানান, পানির এমন সংকট আগে দেখা যায়নি। প্রচণ্ড কষ্ট করে এক কলস পানি নিতে সময় লাগছে আধাঘণ্টা।
আজ বিশ্ব পানি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘পানি মূল্যবান’। উপকূল অঞ্চলের নারীদের জন্য এ কথাটি দিবালোকের মতো সত্য।
বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনডিপির এক যৌথ জরিপ অনুযায়ী, দেশের উপকূলীয় এলাকার অধিবাসীদের পারিবারিক আয়ের ২০-২৫ শতাংশ ব্যয় হয় শুধু খাওয়ার পানির জন্য।
জাতিসংঘের পানিবিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, একজন মানুষের আয়ের ৩ শতাংশ অর্থ খরচের মাধ্যমে তার জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
নগরীর পিটিআই মোড়ের বাসিন্দা মোজাফ্ফার হোসেন বলেন, টিউবওয়েলের পানি আমাদের একমাত্র খাবার পানির উৎস। এখন থেকে শুরু করে বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত কল থেকে মোটেও পানি ওঠানো যায় না। যার কারণে আমাদের মতো যারা অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকে তাদের জন্য খাবার পানির সমস্যাটা প্রকট। বোতলজাত পানিই এখন ভরসা।
সাত রাস্তা মোড়ের ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলাম বলেন, বাড়ি করার সময় এই এলাকায় অনেকেই টিউবওয়েল স্থাপন করেছেন। কিন্তু এখন তারাও পানি পাচ্ছে না। ওয়াসার পানির উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু সেই পানিও এই সময় ঠিকমতো মিলছে না।
মহানগরীর সদর থানার পাশের আরাফাত গলির ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, শুষ্ক মৌসুম শুরু না হতেই খুলনার বেশিরভাগ এলাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হাতে চালিত নলকূপে পানি উঠছে না। ফলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর ধরে শুকনো মৌসুমে এই অবস্থা হয়। কিন্তু এবার আগেই শুরু হয়েছে।
পানির সংকট শুধু খুলনা মহানগরীতেই নয়, নগরীর চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা উপজেলার গ্রামগুলোতে। শহরে ওয়াসা ও সাব মার্সেবল থেকে পানি পানের সুযোগ থাকলেও গ্রামে সেই অবস্থাও নেই। নলকূপ এই উপজেলাগুলোতে কোনো কাজেই আসে না।
গ্রামের অনেককেই পানযোগ্য এক কলস পানির জন্য কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। তারপরই মিলছে কাঙ্ক্ষিত পানি। আর যারা দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে পারছেন না তাদের নগদ টাকার বিনিময়ে কিনতে হচ্ছে খাবার পানি। এভাবেই গ্রীষ্ম শুরু হওয়ার আগেই পানি সংগ্রহে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাদের।
খুলনা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, নগরে নিত্যকাজের জন্য পানির চাহিদা অনেকাংশে খুলনা ওয়াসা পূরণ করতে পারছে। কিন্তু পানীয় পানির চাহিদা মেটাতে পারছে না। টিউবওয়েলের পানিই নগরবাসীর একমাত্র ভরসা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, খুলনা মহানগরের আটটি থানা এলাকায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ বসবাস করেন। খুলনা ওয়াসা ৬০ ভাগ মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করতে পারে। বাকি ৪০ ভাগ মানুষের পানির চাহিদা গভীর-অগভীর নলকূপ এবং ব্যক্তি উদ্যোগে সরবরাহের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। কিন্তু পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলেও পানি উঠছে না।
খুলনা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, খুলনায় গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হতে না হতেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমেছে। জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে পানির স্তর আরও কমছে। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দিনে দুই বার পানি সরবারহ করা হয়। এছাড়া ৫৫টি উত্তোলক পাম্প প্রায় সারাদিনই চালু থাকে। ফলে এখন পানির খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তিনি বলেন, গত ৫ বছরে খুলনায় ৩ ফিটের বেশি পানির লেয়ার নিচে নেমে গেছে। তবুও খুলনা ওয়াসা নগরবাসীর জন্য ১১ কোটি লিটারের বেশি পানি সরবরাহ করছে।
খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার সমাধান এখনই দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও বেশি সময় পানির পাম্প চালিয়ে কিছুটা অতিরিক্ত পানি দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি জানান, পানির সংকট দূর করতে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে নগরীতে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন এভাবে ১১ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আকমল হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশগত নানা সমস্যায় উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে। আইলার আগে এই এলাকায় এতটা পানির সংকট ছিল না। কিন্তু আইলার প্রলয়ে সুপেয় পানির সবগুলো আধার লবণ পানিতে ডুবে যায়। সেগুলো থেকে এখন আর লবণ পানি সরানো যাচ্ছে না। ফলে মিঠা পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে।
তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকার পানি সমস্যা সমাধানে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে এবং এই পানি প্রতিটি পরিবারের জন্য সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চল্লিশটি পুকুর খনন করা হচ্ছে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য সাড়ে ৫ হাজার সংরক্ষণাগার তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় এলাকায় গভীর ও অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা থাকছে।
নদী বন্দর / জিকে