বঙ্গপোসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় এবার ৩১৭ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। এসব তরমুজ পাইকাররা ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যানে পৌঁছে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বেশি ফলন, আকারে বড় ও স্বাদ ভালো হওয়ায় খুশির হাসি তরমুজ চাষিদের মাঝে।
তাদের এখন দম ফেলার সুযোগে নেই। গত কয়েকদিন বেজায় গরম থাকায় দিনভর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরমুজের কেনার জন্য আসছে পাইকার ও আশপাশের খুচরা বিক্রেতারা। চলতি মৌসুমে তরমুজ চাষে ৯ কোটি টাকা খরচ করে অন্তত ২৩ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির প্রত্যাশা করছেন এসব এলাকার প্রায় অর্ধহাজার তরমুজ চাষি।
জানা যায়, ২০১৭ সালে নোয়াখালী এলাকা থেকে আগত এক কৃষক পরীক্ষামূলকভাবে সোনাগাজীর চরদরবেশ ইউনিয়নে তরমুজ চাষ করেন। ওই বছরে তার সফলতা দেখে ২০১৯ সালে ৮ থেকে ১০ জন কৃষক তাদের জমিতে রবি মৌসুমে তরমুজ চাষ করে লাভবান হন।
উৎপাদনে সম্ভাবনা ও ভালো দাম পেয়ে নোয়াখালীর সুবর্ণচর এলাকা থেকে কিছু কৃষক ২০২০ সালে সোনাগাজীর সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় এসে ১০৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে তরমুজ চাষ শুরু করেন।
কম সময়ে বেশি লাভ পাওয়ায় এবার উপজেলার চরছান্দিয়া, চরদরবেশ ও আমিরাবাদ ইউনিয়নে ৩১৭ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে সোনাগাজীতে ১৬০ হেক্টর জমিতে ভিক্টর সুগার জাত, ১২২ হেক্টর জমিতে ওশেন সুগার ব্ল্যাক বেরি, ৩৫ হেক্টর জমিতে অন্যান্য জাতের তরমুজ চাষ হয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানায়, সমুদ্রের উপকূলে জেগে ওঠা সোনাগাজীর চরগুলো বছরের পর বছর অনাবাদী পড়ে থাকতো। বছরের কিছু সময় এসব অনাবাদী জমিকে মহিষের চারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হলেও বেশিরভাগ সময়ই খালি থাকতো। এখন ওইসব অনাবাদি জমিতেই চলছে তরমুজ চাষ।
সোনাগাজীতে তরমুজ চাষিদের বেশিরভাগ কৃষক নোয়াখালীর সুবর্ণচর এলাকা থেকে এসেছেন। স্বল্প সময়ের জন্য চরাঞ্চলে আসা এ কৃষকরা খেতেই তাবু লাগিয়ে অস্থায়ী বসতি তৈরি করেছেন। খেত থেকে তরমুজ তোলা শেষ হলে তারা পুনরায় নিজ এলাকায় ফিরে যাবেন।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র নাথ জানান, চলতি মৌসুমে সোনাগাজীতে ৩১৭ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। এখন চাষিরা তরমুজ তোলা ও বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। স্বাদ ভালো হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকাররা সোনাগাজী থেকে গাড়ি ভর্তি করে তরমুজ নিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন জেলায়।
তিনি জানান, চলতি মৌসুমে সোনাগাজীতে প্রতি হেক্টরে গড়ে ৪৯ মেট্টিক টন তরমুজ চাষ হয়েছে। প্রতি বিঘায় প্রায় ৭ কেজি ওজনের ৯০০ থেকে ৯৫০ পিস তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। এসব তরমুজ উৎপাদনে বিঘাপ্রতি বীজ, সার, পারিশ্রমিক ও জমি লিজ খরচসহ ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা চাষিদের খরচ হয়েছে। এখন প্রতিবিঘায় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করছেন চাষিরা।
প্রতাপ চন্দ্র নাথ আরো জানান, প্রতি হেক্টরে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। এ হিসেবে সোনাগাজীতে ৩১৭ হেক্টর জমিতে অন্তত ২৩ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। এসব তরমুজ উৎপাদনে প্রতি হেক্টরে চাষিদের যাবতীয় খরচসহ ব্যয় হয়েছে মাত্র সাড়ে ৯ কোটি টাকা। বিক্রি শেষে তরমুজ চাষে সম্পৃক্ত ৪ শতাধিক কৃষকের অন্তত ১৪ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা লাভ হতে পারে বলে মনে করেন কৃষি বিভাগের এ কর্মকর্তা।
নোয়াখালীর সুবর্ণ চর থেকে আসা তরমুজ চাষি মিয়াধন জানান, বিগত ডিসেম্বর মাসে আমিসহ এলাকার কয়েকজন মিলে চরদরবেশ এলাকায় ২ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করি। এখানে খেতের মাঝেই তাবু দিয়ে থাকা-খাওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছি।
গত কয়েকদিন অতিরিক্ত গরমে হঠাৎ তরমুজ পাইকারদের আনাগোনা বেড়ে যায়। আমরা ইতোমধ্যে ১০ বিঘার তরমুজ ৯ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছি। পাইকাররা দিনরাত কাভার্ডভ্যান ভর্তি করে এসব তরমুজ নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, স্থানীয় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তরমুজ বিক্রি করলে আরো বেশি দাম পাওয়া যায়। তবে এতে কিছু ভোগান্তিও আছে।
চট্টগ্রামের বহদ্দার হাট থেকে পাইকারি তরমুজ ক্রয় করতে আসা মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, সোনাগাজীতে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে খবর পেয়ে তিনি গত মৌসুমে স্বল্প পরিসরে এখান থেকে তরমুজ নিয়ে ভালো লাভ করেছিলেন।
তাই এবার ২০ লাখ টাকা নিয়ে পাইকারি তরমুজ নিতে এসেছেন। ইতোমধ্যে ৮ লাখ টাকার তরমুজ ক্রয় করে চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলার খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেছেন। তার মতে, এবার খুচরা বাজারে তরমুজের দাম বেশি। তাই লাভও ভালো হবে।
সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন মজুমদার জানান, চলতি মৌসুমে সোনাগাজীতে তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে। আকারে প্রতিটি তরমুজ ৬ থেকে ৭ কেজি হওয়ায় ও দাম ভালো পাওয়ায় চাষিরা ভালো লাভবান হবেন। এছাড়াও স্বাদ ভালো হওয়ায় পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারাও সোনাগাজীর তরমুজ বিক্রি করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আগামী ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যেই তরমুজ তোলা শেষ হবে বলে জানান তিনি।
নদী বন্দর / পিকে