আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। বৈশাখ শুরুর আগেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের চার নদীতে কবিতার সেই হাঁটু জল। ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মহানন্দা হুৎপিণ্ড বলে থাকেন অনেকেই। উৎসমুখে পানি কম পাওয়ায় বাংলাদেশের অন্যতম বড় নদী মহানন্দা প্রতি বছর তার নাব্যতা হারাচ্ছে। পানি প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হওয়ায় বছরে বছরে মহানন্দা নদীর পানিপ্রবাহ সর্বনিম্ন স্তরে এসে পৌঁছেছে।
পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা আশঙ্কাজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে। উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে হুমকির মুখে পড়েছে সেচ প্রকল্প। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাথে পানির স্তরে সঠিক পরিমাণ পানি না পাওয়ায় পানীয় জল ও সেচের চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
মহানন্দা নদী মূলত হিমালয় কেন্দ্রীক নদী। ভারতের দার্জিলিং জেলার কুরসেউংগের পূর্বে চিমলির কাছে মহালদিরাম পাহাড়ের পাগলা ঝোরা জলপ্রপাত থেকে এটি উৎসারিত। বাংলাদেশে এটি দুই অংশে প্রবেশ করেছে। যার একটি পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া বাজার দিয়ে। অন্যটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার গিলাবাড়ী বিওপি সংলগ্ন স্থান দিয়ে।
মহানন্দা শেষ হয়েছে গোদাগাড়ীর কাছে পদ্মায় মিলিত হওয়ার মাধ্যমে। ভোলাহাটের বিপরীতে ভারতের মালদা জেলায় মহানন্দা প্রবেশ করে দুটি অঞ্চলের সৃষ্টি করেছে। মহানন্দার মোট দৈর্ঘ্য ৩৬০ কিলোমিটার। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এর দৈর্ঘ্য ৯৬ কিলোমিটার। এটিই একমাত্র নদী যা জেলার পাঁচটি উপজেলার সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মহানন্দা নদী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনেক বেশি অবদান বলে বিবেচিত। বলা হয়ে থাকে মহানন্দা চাঁপাইনবাবগঞ্জের হৃৎপিণ্ড।
পাঁচ বছরের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, মহানন্দায় ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল সর্বনিম্ন পানির উচ্চতা ছিল ১১.৫২ মিটার, ২০১৪ সালের ১ মে উচ্চতা ছিল ১১.৬১ মিটার, ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ উচ্চতা ছিল ১১.৯৬ মিটার, ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল ছিল ১১.৬০মি, ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল ১১.০৫ মিটার আর সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১১.৩৫ মিটার। এই পরিসংখ্যানে প্রতীয়মান হয় শুষ্ক মৌসুমে মহানন্দায় পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে।
পাঁচ বছরের মধ্যে পরপর দুইবার পানির উচ্চতা সর্বনিম্ন স্তরে উপনীত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে সূত্রে জানা গেছে, উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করায় পানি প্রাপ্যতা অনিশ্চিত এবং পানি শুকিয়ে নাব্যতা হারানোর কারণে মহানন্দা খালে পরিণত হয়েছে। উৎসমুখে ভারতীয় পশ্চিম দিনাজপুরের মহানন্দায় রাবার ড্যাম তৈরির কারণে শুষ্ক মওসুমে পানির অভাব হচ্ছে। এদিকে বৃষ্টিপাতও কমে গেছে।
যে বৃষ্টিপাত হয় তাতে পানিপ্রবাহে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় না। তা ছাড়া নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। সাধারণত পানির স্তর রিচার্জ হয় গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জের মাধ্যমে। এটারও হার কমে গেছে। একই কারণে মহানন্দার চিরায়ত অবয়ব দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। নদীটির গড় প্রস্থ যেখানে ছিল প্রায় ৫০০ মিটার সেখানে বর্তমানে এটির পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৫০/৪০ মিটারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৯৬ কিলোমিটার। দীর্ঘ নদীর চলমান প্রবাহ স্তিমিত হওয়ার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কোথাও এর হাঁটুপানি। কোথাও প্রবাহহীন অবস্থা, আবার কোথাও কোথাও বালুর চর জেগে উঠেছে। এ রকম দশায় পানির নাব্যতা ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় মহানন্দায় পানি সংরণ ব্যবস্থা যেমন হুমকির মুখে পড়েছে তেমনি মারাত্মক তির মধ্যে পড়েছে নদীকেন্দ্রিক অসংখ্য পানি সেচ প্রকল্প।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে মহানন্দায় ৬০টি সমিতিভুক্ত পানি সেচ প্রকল্প ছাড়াও অসংখ্য ক্ষুদ্র সেচ স্কিম রয়েছে। সারা বছর ধরেই মহানন্দার পানি দিয়ে সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে শুষ্ক মওসুমে এসব প্রকল্প পুরোটাই নদীনির্ভর হয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত পানির অভাবে সেচ প্রকল্পগুলোর আওতায় অন্তত প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমি সেচসঙ্কটে উপনীত হয়েছে।
এদিকে ১৫৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় গৃহীত মহানন্দা নদী খনন ও রাবার ড্যাম নির্মাণ প্রকল্পটির পরিকল্পনা ২০১৮ তে শুরু হয়। সাধারণত ড্রেজিং মওসুম ধরা হয় নভেম্বর ফেব্রুয়ারি মাসকে। সে সময় পানির গড় প্রবাহ ভালো থাকে। ড্রেজিংয়ের জন্য কমপক্ষে দুই মিটার পানির উচ্চতা থাকতে হয়। যা এ মুহূর্তে নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম জানান, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অধীনে নারায়ণগঞ্জ ডক ইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি চালিত হচ্ছে। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে গোমস্তাপুরের চৌডালা ব্রিজ পর্যন্ত সুবিধাপ্রাপ্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হবে। রাবার ড্যাম সম্পন্ন হলে মহানন্দার ধারে অতিরিক্ত তিন হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা বাড়বে।
প্রায় সাত হাজার হেক্টর জমি সেচের অওতায় আসবে। এই সাথে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর আম বাগান সেচ সুবিধা প্রাপ্ত হবে। অতিরিক্ত ৫৫ কোটি টাকার বাড়তি ফসল উৎপাদিত হবে। মহানন্দা তীরবর্তী যে ২৫ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে তার মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার হেক্টরই উপকৃত হবে। পুরো প্রকল্প এলাকায় চার মিটার পানি ধরে থাকবে বলেও তিনি জানান।
এদিকে পরিবেশবিদরা জানান, প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে বর্ষায় উজান থেকে প্রচুর পরিমাণে পলি এসে মহানন্দা ভরাট হচ্ছে। এতে করেও নাব্যতা হারাচ্ছে মহানন্দা। তাদের মতে নদীতে পানি শূন্যতায় জীব বৈচিত্র্যও পরিবেশের ওপর বড় ধরনের তিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে।
এপ্রিল-মে-জুন মাস হচ্ছে মাছসহ অনান্য জলজ প্রাণীর প্রজনন সময়। কিন্তু পানির অভাবে প্রজনন ব্যাহত হয়ে মৎস্যসঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে দেশীয় বিভিন্ন জলজ প্রাণী। যাদের মধ্যে অনেক জাত ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মতো প্রকাশ্যে উঠে আসে এসব চিত্র।
নদী বন্দর / এমকে