নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে পুরোদমে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা দিয়েছে।
শনি ও রবিবার নেত্রকোনা জেলার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার বিভিন্ন হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্র কৃষকেরা ধান কাটা, মাড়াই ও শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছে। কোথাও কৃষি শ্রমিক, কোথাও আবার সরকারের ভর্তুকি দেয়া কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। ধান কাটা ও মাড়াই নিয়ে হাওরাঞ্চলে কৃষকদের মাঝে এক ধরণের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। গত কয়েক দিন আগে গরম ঝড়ো বাতাসে হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের আংশিক ক্ষতি হওয়ার পরও বেশীরভাগ হাওরে ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকরা খুশি।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মওসুমে নেত্রকোনা জেলায় ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৯ শত ৮৩ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত খালিয়াজুরী উপজেলায় ২০ হাজার ১ শত হেক্টর, মদন উপজেলায় ১৭ হাজার ৩ শত ৪০ হেক্টর, মোহনগঞ্জ উপজেলায় ১৭ হাজার ৪৩ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭ লক্ষ ৬৪ হাজার ৪ শত ৯৩ মেট্রিক টন।
হাওরাঞ্চলে কৃষকদের সারা বছরের একমাত্র ফসল হচ্ছে বোরো ধান। আগাম বন্যা কিংবা শিলাবৃষ্টিতে তাদের হাড়ভাঙ্গা কষ্টে ফলানো সোনার ফসল যাতে কোন ধরণের ক্ষয়-ক্ষতি না হয়, তার জন্য কৃষাণ কৃষাণীরা পাকা ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে। কৃষকরা জানায়, এপ্রিলের ১০/১২ তারিখ থেকে হাওরে ব্রি আর ২৮ ধান কাটা শুরু হয়েছে। আর এখন ব্রি আর ২৯ ধান কাটা শুরু হয়েছে। হাওরাঞ্চলে ধান কাটা শ্রমিকের তীব্র সংকট রয়েছে। অনেক কৃষক ধান কাটা, মাড়াই ও শুকাতে তাদের স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদেরকে যুক্ত করছেন।
ডিঙ্গাপুতা হাওরে ধান কাটারত মল্লিকপুর গ্রামের কৃষক চন্দন জানান, গেল কয়েক বছরের চেয়ে এবার ডিঙ্গাপোতা হাওরে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তিনি ৮৫ কাটা জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ করেছেন। তিনি কাটা প্রতি ৭ থেকে ৮ মন ধান পেয়েছেন।
শেওড়াতলী গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন জানান, ধান কাটার পর জমিতেই ভেজা ধান ৮ শত ২৫ টাকা মন দরে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। হাটনাইয়া গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া জানান, আগাম বন্যা কিংবা শিলাবৃষ্টিতে যাতে ধানের কোন ক্ষতি না হয় তার জন্য হারভেস্টার মেশিন দিয়ে দ্রুত জমির ধান কাটার চেষ্টা করছি।
মদন উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কৃষক রমজান মিয়া জানান, মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে দাদন নিয়ে জমিতে ধান রোপন করেছি। ধানের ভাল ফলন হয়েছে। আশা করি, মহাজনের দার দেনা সুদ করেও ছেলে মেয়েদের নিয়ে ভাল ভাবে জীবন যাপন করতে পারবো।
খালিয়াজুরী উপজেলার বল্লভপুর গ্রামের সঞ্জিত তালুকদার বলেন, ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে আমরা ধানের ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। সরকার যদি সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান খরিদ করতো তাহলে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা আরো বেশী লাভবান হতো।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান জানান, মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের সময়মতো সঠিক পরামর্শ দেওয়ায় এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় হাওরাঞ্চলে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সম্প্রতি গরম ঝড়ো হাওয়ায় হাওরাঞ্চলে ৭ হাজার ৪ শত ৪৪ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে।
তারপরও আশা করছি, এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদিত হবে। জেলা প্রশাসক কাজি মোঃ আব্দুর রহমান জানান, মহামারী করোনা সংকটকালে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধান কাটেন, তার জন্য হাওর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও শ্রমিক সংকট দূর করতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
আশা করছি, হাওরাঞ্চলের কৃষকরা নির্বিঘ্নে তাদের পরিশ্রমের ফসল ভালভাবেই ঘরে তুলতে পারবেন।
নদী বন্দর / এমকে