বগুড়ার শেরপুরে মহামারি করোনার মাঝেও থেমে নেই ফসলি জমি কেটে মাটি ও বালু লুট। স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীসহ সব মহলকে ম্যানেজ করে অনেকটা দাপটের সঙ্গেই লুটের এই মহোৎসবে মেতেছেন প্রভাবশালী বালুদস্যুরা। তাই অনেকটা নির্বিঘ্নেই দিনে-রাতে সমানতালে ড্রেজার ও খননযন্ত্রের মাধ্যমে চলছে ফসলি জমির বুক চিরে অবৈধভাবে মাটি-বালু উত্তোলন। এতে করে শতশত বিঘা কৃষি জমি বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে কমতে শুরু করেছে খাদ্য উদ্বৃত্ত।
বালুখেকোরা এতটাই বেপরোয়া যে তাদের থাবায় পল্লী বিদ্যুতের ১১ হাজার ভোল্টের সঞ্চালন লাইনও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে এই বিদ্যুৎ লাইনের চার-পাঁচটি খুঁটি ঘিরে বসবাসকারী আঠারোটি পরিবারসহ আশপাশের লোকজন যেকোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা নিয়ে দিনাতিপাত করছেন।
এদিকে কৃষি জমির সর্বনাশ করে অবাধে কাটা মাটি যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। অতিরিক্ত মাটি পরিবহন আর ওভারলোডেড ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টর চলাচলের ফলে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, উপজেলা ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে খামারকান্দি বড়বিলা ও শালফা এলাকায় ফসলি জমি থেকে মাটি-বালু উত্তোলন করছেন বালুখেকোরা। এই দুই পয়েন্টে প্রশাসনিক কোনো ঝামেলা হয় না। তাই দিনে-রাতে সমানতালে চলছে মাটি কাটা ও বালু উত্তোলন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, এই উপজেলার দশটি ইউনিয়নে অন্তত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি জায়গায় খননযন্ত্রের মাধ্যমে ফসলি জমি কেটে মাটি-বালু লুটে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আরও আট থেকে দশটি জায়গায় জলাশয় সংস্কারের নামে মাটি কেটে বিক্রির পাশাপাশি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের দায়সারা অভিযানে মাঝেমধ্যে দু’একটি পয়েন্ট বন্ধ থাকলেও অদৃশ্য খুঁটির ইশারায় আবারও চলছে মাটি-বালু উত্তোলন।
মহামারী করোনার মাঝেও বন্ধ নেই অবৈধ এই কর্মযজ্ঞ। তবে একটু ধরন পাল্টেছে। নির্বিঘ্ন করতে দিনের পরিবর্তে রাতকে বেছে নেওয়া হয়েছে। আর এই কাজে জড়িত শতাধিক প্রভাবশালী বালুদস্যুর রাজনৈতিক পদ-পদবি না থাকলেও সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী-সমর্থক। তাই প্রশাসনসহ সব মহলকে ম্যানেজ করতে তেমন বেগ পেতে হয় না তাদের।
প্রভাবশালী এই দস্যুবাহিনী প্রথমে বিশাল মাঠের মাঝখানে কমদামে জমি কিনে থাকেন। এরপর সেই ফসলি জমি থেকে শুরু করেন মাটি বিক্রি। সেইসঙ্গে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে রাতের আঁধারে তোলা হয় বালু। তৈরি হয় বিশাল আকারের গর্ত। স্বাভাবিক কারণেই আশপাশের জমি ভাঙতে শুরু করে। এরপর ভয় দেখিয়ে ওইসব ফসলি জমি কিনে শুরু করা হয় মাটি-বালু উত্তোলন। এভাবে মাটি-বালুর লোভে কৃষি জমির সর্বনাশ করা হচ্ছে।
এছাড়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের নন্দতেঘরী গ্রামে মাটিদস্যুদের থাবায় একটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ১১ হাজার ভোল্টের সঞ্চালন লাইনের ঝুঁকিপূর্ণ চার-পাঁচটি খুঁটি এখনও দাঁড়িয়ে থাকলেও খুঁটির চারপাশের মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খননযন্ত্রের মাধ্যমে এসব মাটি কাটা হয়েছে।
প্রায় আট ফুট গর্ত করে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ায় জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। এতে জমির মালিকরা লাভবান হলেও বড় বিপদ চেপেছে সাধারণ গ্রামবাসীর ওপর। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় খেসারত দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের।
নন্দতেঘরি গ্রামের বাসিন্দা ভুক্তভোগী মোহাব্বত আলী, আব্দুস সোবহান, সিরাজুল ইসলামসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম শুরু হয়েছে। যেকোনো সময় ঝড়ে এই বিদ্যুৎ লাইনের খুঁটি উপড়ে বা ভেঙে তাদের বসতবাড়ির ওপর পড়তে পারে। ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। ঝুঁকিপূর্ণ লাইন স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে ৪ এপ্রিল বগুড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। এতে গ্রামের ভুক্তভোগী ২৪ জন গ্রামবাসী স্বাক্ষর করেছেন।
এছাড়া ভবানীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের মেম্বার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সমাধান করার জন্য জোর সুপারিশ করেন। কিন্তু অদ্যবধি লাইনটি স্থানান্তরের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এসব ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ঝুঁকিপূর্ণ এই লাইনটি স্থানান্তর করতে খরচ হিসেবে গ্রামবাসীর কাছে মোট ১ লাখ ৪২ হাজার ৭শ টাকা দাবি করেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির শেরপুর জোনাল অফিসের কর্তা ব্যক্তিরা। এ অবস্থায় ওই গ্রামটিতে বসবাসকারীরা চরম ঝুঁকির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন বলে জানান তারা।
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফসলি জমি কেটে মাটি ও বালু লুটের মহোৎসবে মেতেছেন উপজেলার খামারকান্দি ইউনিয়নের শুভগাছা এলাকার লাভলু মিয়া, ভাতারিয়া ও বোয়ালমারিতে বিধান চন্দ্র, কাফুড়া নিসকিপাড়ায় আইয়ুব আলী, খামারকান্দির বড়বিলায় নান্নু মিয়া, গাড়িদহ ইউনিয়নের দামুয়া গ্রামে আব্দুল খালেক, চন্ডিজান এলাকায় আনোয়ার হোসেন, মির্জাপুর ইউনিয়নের রাজবাড়ী ও শংকরহাটা গ্রামে আব্দুল মজিদ, দড়িমুকন্দ্র ও মাকোরকোলায় আব্দুল খালেক মিয়া, খানপুর ইউনিয়নের ভস্তাবিলে নজরুল ইসলাম ও বেল্লাল হোসেন, কুসুম্বী ইউনিয়নের পানিসারা হিন্দুপাড়া গ্রামে শ্যাম ঠাকুর, দক্ষিণ আমইনে আব্দুল মান্নান মিয়া, নামা জামুর গ্রামে হেলাল উদ্দিন। এছাড়া ভবানীপুর ইউনিয়নের বড়াইদহ, ছোনকা ইটভাটার পাশে, কুসুম্বী ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া-উঁচুলবাড়িয়া, ধাওয়াপাড়া, টুনিপাড়া, হাপুনিয়া বটতলা, আলতাদিঘী বোর্ডের হাটসহ আরও অন্তত ২০টি পয়েন্টে ফসলি ও জলাশয় সংস্কারের নামে বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার অবৈধ উৎসব চলছে।
ভুক্তভোগী কৃষক আব্দুল হামিদ বলেন, আমার পাশের ছয় বিঘা জমি কিনে মাটি-বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী বালুদস্যুরা। এ কারণে সেখানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আমার দুই বিঘা ফসলি জমিও ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এছাড়া সড়কের পাশের জমিগুলোতেও ট্রাক থেকে মাটি-বালু পড়ে সবজি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু বলার কিছুই নেই। নিষেধ করলে জমি বিক্রি করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এমনকি বেশি বাড়াবাড়ি না করার জন্যও এলাকার চিহিৃত ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়। তাই ভিটেমাটি শেষ হয়ে গেলেও তাদের মতো গ্রামের সাধারণ মানুষের পক্ষে করার কিছুই নেই বলে আক্ষেপ করেন তিনি।
খানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম রাঞ্জু অভিযোগ করে বলেন, সরকারি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফসলি জমি কেটে অবাধে মাটি-বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর এসব মাটি পরিবহনের ওভারলোড ট্রাকের কারণে গ্রামীণ পাকা সড়ক নষ্ট হচ্ছে।
বিষয়টি প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের জানানোর পর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে মাটি-বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর দু’একদিন বন্ধ থাকলেও আবারও আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে ওদের।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা মাসুদ আলম বলেন, ফসলি জমির মাটি কাটার কোনো সুযোগ নেই। জমির উপরিভাগের মাটি কাটার কারণে উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। আর বালু উত্তোলন করা হলে ধসে গিয়ে বড় বড় গর্ত হয়ে বিনষ্ট হবে। তাই যেকোনো মূল্যে কৃষি জমি রক্ষা করতে হবে। কারণ কৃষি জমি কমে গেলে খাদ্য উদ্বৃত্ত এই উপজেলায় খাদ্যের সংকট দেখা দেবে। বিষয়টি সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাবরিনা শারমিন বলেন, অনুমতি ছাড়া জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই ফসলি জমি কেটে মাটি-বালু উত্তোলন করার খবর পেয়ে একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। জরিমানাসহ বেশ কয়েকটি খননযন্ত্রও জব্দ করা হয়েছে। এই অভিযান চলমান রয়েছে। খোঁজখবর নিয়ে সব বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
নদী বন্দর / পিকে