চলছে তীব্র দাবদাহ। তার উপর বৃষ্টি হয়নি প্রায় সাত মাস। চৈত্রের কাঠফাটা রোদে শুকিয়ে গেছে খাবার পানির একমাত্র উৎস পুকুর, জলাশয়। নলকূপের পানি লোনা। মুখে নিলে গাল পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। খাবার পানি মিলছে না কোথাও। এক কলস পানি সংগ্রহ করতে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে লাইনে দাঁড়তে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর মেলে এক কলস পানি। এমন করুণ চিত্র সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলের ধুমঘাট গ্রামের।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট গ্রামের শরিফ ডাক্তারের বাড়ির একটি মাত্র পুকুর এলাবাসীর একমাত্র ভরসা। কঙ্কালসার ও প্রায় শুকিয়ে যাওয়া এই পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন পুরো গ্রামের মানুষ।
পানি নিতে আসা গৃহবধূরা জানান, তারা এসেছেন ৩-৪ কিলোমিটার দূর থেকে। কিন্তু পুকুরটিতে যে পানি আছে তা দুই সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তারপর কী হবে তা কেউ জানে না। এমন চিত্র সাতক্ষীরার উপকূলের গ্রামগুলোতে।
পানি সংগ্রহে আসা নারী, শিশুসহ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই থেকে চার কিলোমিটার পর্যন্ত দূরবর্তী কাছিহারানী, দেওল, কাঠালবাড়িয়া ও খুটিকাটা গ্রাম থেকে এসেছেন তারা। নিজেদের গ্রামে পুকুরের পানি ঘোলা ও লবণাক্ত হওয়ায় তা পানের অযোগ্য। আর্সেনিক ও আয়রন থাকার পাশাপাশি টিউবওয়েলর পানিও লবণাক্ত। এ কারণে জীবন বাঁচানোর তাগিদে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে দূরবর্তী গ্রাম পাড়ি দিয়ে পুকুরে পানি নিতে আসে।
পানির ফিলটারগুলোতে এক কলস পানির জন্য মানুষ তিন-চার ঘণ্টা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। সেখানেও পানি স্বল্পতা থাকায় দূর দূরান্তে ছুটছে মানুষ। গোসল ও গবাদি পশুকে খাওয়ানোর মতো পানিও মিলছে না কোথাও কোথাও। অনাবৃষ্টি আর তীব্র দাবদাহে কষ্ট বেড়েছে কয়েকগুণ।
স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা বারসিকের কর্মী গাজী আল ইমরান জানান, যেখানে নলকূপ রয়েছে সেখানেও ঠিকমতো পানি উঠছে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পানির জন্য এসব এলাকায় একপ্রকার হাহাকার অবস্থা। পানি সংকট নিরসনে পুকুর খনন ছাড়া সরকারিভাবে স্থায়ী কোনো উদ্যোগ নেই। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পানির ট্যাংক বিতরণসহ ফিল্টার স্থাপন করে দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, গেল বছর সুপার সাইক্লোন আম্পানে উপকূলের বেড়িবাঁধ ভেঙে সর্বত্র লোনা পানি ঢুকে পড়ে। বাড়িঘর, ফসলি জমি, মাছের ঘের ভেসে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই এলাকার একমাত্র পানির উৎস পানির আঁধার (পুকুরগুলো)। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ অঞ্চলে পানির ব্যবস্থা না করলে মানুষ তীব্র পানি সংকটে পড়বে। দেখা দিতে পারে মানবিক বিপর্যয়।
শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান বলেন, এই অঞ্চলের মানুষ সুপেয় পানির জন্য বৃষ্টি ও পুকুরে পানির ওপর নির্ভরশীল। তবে গেল সাত মাস কোনো বৃষ্টি হয়নি। পুকুরগুলো শুকিয়ে গেছে। গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় বেশকিছু সুপেয় পানির প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু পুকুর লবণ পানিতে তলিয়ে যায়। এজন্য এ বছর খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে এসব এলাকায় একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা স্বল্পমেয়াদী কিছু প্রকল্পের মাধ্যেমে পানির সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে তা পর্যাপ্ত নয়।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, উপকূলীয় দুই উপজেলা আশাশুনি ও শ্যামনগরে খাবার পানির তীব্র সংকট রয়েছে। এসব এলাকায় সরকারি একাধিক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে খাবার পানির সংকট কিছুটা কমবে। এসব এলাকায় সুপেয় পানি সংকট দূর করতে পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প প্রয়োজন।
সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার বলেন, দুর্যোগপ্রবণ বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে খাবার পানির সংকট নিরসনে ইতোমধ্যে প্রতিঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। আরো কয়েকটি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া এই বিপুল সংখ্যাক মানুষের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।
নদী বন্দর / পিকে