পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর, জয়নগর, মিরকামারি, চর-মিরকামারি, মানিকনগর, বাবুল চড়া, কাঠালবাড়িয়া, চর গড়গড়ি, দাদাপুর, পাকুরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম এখন লিচু আবাদ হচ্ছে। কামালপুর, চরকুড়ুলিয়ার মতো বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলেও খুব দ্রুত গড়ে উঠছে লিচুপল্লী। এ অঞ্চলের বেলে-দোআঁশ মাটি ও আবহাওয়া লিচু চাষের জন্য খুব উপযোগী।
ফলন ভালো ও গুণে-মানে সেরা হওয়ায় ঈশ্বরদীর লিচুর কদরও সারাদেশে। বরাবর ভালো দাম পাওয়ায় লিচুচাষে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা। এসব এলাকার সড়ক বা মহাসড়ক ধরে গেলে রাস্তার দু’পাশে চোখে পড়ে শুধু লিচু লিচু। কিন্তু এবার দৃশ্যপট ভিন্ন। এবার লিচুগাছে শুধু শুধু পাতা আর পাতা। পাতার ফাঁকে উঁকি মারছে দু’চারটি লিচু।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাত্র ২০ ভাগ গাছে এবার মুকুল এসেছিল। আর বেশিরভাগ গাছই ছিল মুকুলশূন্য। প্রতিবছরের মতো এবারও গাছের পরিচর্যা করেছেন কিন্তু পর্যাপ্ত মুকুল না আসায় চিন্তার শেষ নেই তাদের। মুকুল না আসায় বিশেষ করে বোম্বাই জাতের লিচুর ফলন লক্ষ্যমাত্রার এক-পঞ্চমাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ না ওঠায় চাষিরা লোকসানে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবারে ঈশ্বরদীতে লিচু ফলনে বিপর্যয় ঘটেছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, এবছর হঠাৎ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লিচুগাছে কাঙিক্ষত মুকুল আসেনি। ফলনও হবে অনেক কম। এতে সারাদেশের লিচুর জোগানেও ঘাটতি হবে। কারণ সারাদেশের লিচুর চাহিদার একটি বড় জোগান আসে এখান থেকে। তবে এবার যে পরিমাণ মুকুল এসেছে তাতে উৎপাদন খরচ না ওঠায় চাষিদের লোকসানে পড়তে।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর, মানিকনগর, জয়নগর, মিরকামারি, আওতাপাড়া, বাঁশেরবাধা, সদর উপজেলার চকউগ্রগড়, জোয়ারদহ, হামিদপুর, জয়কৃষ্ণপুর, উগ্রগড়, মৌগ্রাম, আটঘরিয়া উপজেলার গোপালপুর, ত্রিমোহন, পরানপুর, হিদাশকোল, চাচকিয়া, ষাটগাছা, ডেঙ্গারগ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে সারি সারি এমন লিচুর বাগান। এবছর শুধুমাত্র ঈশ্বরদীতে তিন হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২০ হাজার মেট্টিক টন। প্রতিবছর ৫ থেকে ৬শ’ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয় এখানে। প্রতিবছর লিচুর বাম্পার ফলন হলেও এবার দেখা দিয়েছে বিপরীত চিত্র। গাছগুলোতে দেখা মিলছে না পর্যাপ্ত মুকুল। এতে ফলনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে।
লিচুচাষিরা বলছেন, এ বছর প্রাকৃতিক কারণে প্রায় ৫ ভাগের ৪ ভাগ গাছে মুকুলই ছিল না। গাছে মুকুল আসার পর গুঁটি তৈরির সময় বিপর্যয় দেখা দেয়। পরবর্তীতে দাবদাহ এবং খরার কবলে পড়ে লিচুগাছ। লিচুর গায়ে কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে যায়। লিচু পরিপক্ক হওয়ার পর অনেক লিচু ফেটে যাচ্ছে।
লিচুচাষিরা জানান, দাবদাহের কারণে গাছেই লিচু ফেটে যায়। এজন্য অনেক চাষি বাগানে সেচ দিয়ে ও গাছে পানি ছিটিয়ে কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে গেছে।
লিচুচাষি মিজানুর, আজিজল মল্লিক, আলম শেখ, মুন্না সরদার, আয়েজ উদ্দিন জানান, লিচুর বাগান করে তারা এবার চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। হাজার হাজার টাকার সার বিষ দিয়েও বাগানে মুকুল না আসায় তারা লোকসানে পড়েছেন।
ঈশ্বরদীর মানিকনগর গ্রামের বাগান মালিক জহুরুল ইসলাম বলেন, আমার তিন বিঘা জমিতে লিচু বাগান রয়েছে। গতবছর ফলন ভালো হওয়ায় প্রায় তিন লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেছিলাম। কিন্তু এবারে সিকি (চার ভাগের এক ভাগ) গাছে হয়তো মুকুল এসেছিল। এবার গতবারের চেয়ে অর্ধেকেরও কম টাকার লিচু বিক্রি করতে হবে।
লিচুচাষে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক কিতাব মণ্ডল জানান, বিগত বছরগুলোর যে বাগান থেকে সাত লাখ টাকার লিচু বিক্রি হয়েছিল, এবারে মুকুল না আসায় মাত্র এক লাখ টাকার বেশি লিচু বিক্রি করা যাবে কি-না সন্দেহ রয়েছে।
লিচুচাষে কৃষক এতো আগ্রহী হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নে ঈশ্বরদীর লিচুচাষি বাদশা মিয়া জানান, অন্যান্য ফসল চাষ করে লাভ কম হওয়ায় চাষিরা লিচুচাষে আগ্রহী হচ্ছেন। লিচু চাষে জমি নষ্ট হয় না। বাগান করার প্রথম ৩-৪ বছর অন্যান্য ফসল পূর্ণ ফলনে পাওয়া যায়। পরবর্তীতেও সাথী ফসল হিসেবে হলুদ, তরমুজসহ অন্যান্য ফসল চাষ করা যায়।
ছলিমপুর গ্রামের সফল চাষি হাসেম উদ্দিন। জানালেন লিচুর আয় থেকে সংসার চালিয়ে দুই মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেকেও বড় করেছেন। বর্তমানে তার মালিকানায় রয়েছে বিশালাকৃতির ৬৫টি লিচুগাছ। প্রতি মৌসুমে ৫ থেকে ৮ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেন। কিন্তু এবার লিচু না আসায় তার চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।
মানিকনগর গ্রামের মো. হাফিজুর রহমান মুকুলের দুই শতাধিক লিচুগাছ রয়েছে। তিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে লিচুচাষ করে আসছেন। মুকুল বলেন, এবার গাছে পর্যাপ্ত মুকুল না আসায় এবং দাবদাহের কারণে লিচুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার এবার লিচুর মুকুল কম আসার কারণ জানিয়ে বলেন, সাধারণত জানুয়ারি মাসের শেষে এবং ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে বোম্বাই লিচুগাছে মুকুল আসে। কিন্তু এবারে মধ্য জানুয়ারি থেকে হঠাৎ করে শীতের প্রকোপ কমে যাওয়ায় মুকুল কম অঙ্কুরিত এবং বেশি পরিমাণ পাতা গজিয়েছে। তবে মোজাফ্ফর জাতের লিচুর মুকুল জানুয়ারির প্রথম দিকে আসায় এই জাতে কোনো সমস্যা হয়নি।
ঈশ্বরদীতে বোম্বাই লিচুর চাষই সবচেয়ে বেশি হয়। এজন্য ঈশ্বরদীর চাষিরা চরম ক্ষতির মুখে। তিনি জানান, সারের মাত্রার কমবেশির কারণেও মুকুল না আসতে পারে। এজন্য সারের মাত্রাটি তাদের কাছ থেকে জেনে নিলে চাষিরা উপকৃত হবেন।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বলেন, লিচু ঈশ্বরদীর অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। ফলন্ত প্রতিটি গাছে ৩ হাজার থেকে ৩০ হাজার পর্যন্ত লিচু ধরে। গত বছর ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৬শ’ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছিল। গত বছরের চেয়ে এবারে অতিরিক্ত আরও প্রায় ২০০ হেক্টর জমি লিচু আবাদের আওতায় এসেছে। এখানে প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ হাজার মেট্রিক টন লিচু উৎপাদন হয়। টাকার হিসেবে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার লিচু ঈশ্বরদীতে বিক্রি হয়। কিন্তু এবারে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বোম্বাই জাতের লিচুর মুকুল শতকরা ৩০ ভাগে নেমে এসেছে। এতে চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তবে এটা প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট। তাই তাদের কিছুই করার নেই।
নদী বন্দর / পিকে