বাংলাদেশ ও ভারতের আপত্তি উপেক্ষা করেই ব্রহ্মপুত্র নদীর উৎসের কাছে তিব্বতে বিশাল বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কথা ঘোষণা করেছে চীন। চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ইয়ান ঝিয়ং-কে উদ্ধৃত করে সে দেশের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’ এ খবর দেওয়ার পরই ভারতের বিশেষজ্ঞরা বিপদের ইঙ্গিত দেখছেন। বাংলাদেশেরও এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে তারা মনে করছেন।
ইয়ান ঝিয়ং জানিয়েছেন, ইয়ারলাং জাংবো (ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা নদীকে তিব্বতে এই নামেই ডাকা হয়) নদীর ওপর এই যে প্রকল্পটি তৈরি হচ্ছে ‘ইতিহাসেই তার কোনও তুলনা নেই’। চীনের জলসম্পদ রক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও এটির গুরুত্ব অপরিসীম হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তার মতে, আর সব অর্থেই এটি হতে যাচ্ছে একটি ‘সুপারড্যাম’।
বস্তুত তার সংস্থাই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে। আগামী বছর থেকে চীনে যে ১৪তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০২১-২৫) রূপায়ণ শুরু হচ্ছে, তাতেও বিরাট প্রাধান্য পাচ্ছে এই প্রকল্পটি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যে ইউচ্যাট অ্যাকাউন্ট আছে, সেখানেও এটির কথা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
‘অথচ ভারত ও বাংলাদেশ বহু দিন ধরেই ব্রহ্মপুত্রের ওপর এই মাপের সুপারড্যাম নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছে। দিল্লি ও ঢাকার পক্ষ থেকে চীনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে আগে একাধিকবার প্রতিবাদও জানানো হয়েছে। কিন্তু এই ঘোষণায় স্পষ্ট যে বেইজিং সেটাতে কর্ণপাত করছে না’— বলে জানিয়েছেন ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ যোগিন্দর কুমার অলগ।
আসামে গৌহাটি আইআইটি’র অধ্যাপক ও জলসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. অরূপ কুমার শর্মাও মনে করছেন, ব্রহ্মপুত্রে উৎসের কাছে এত বড় আকারের বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হলে ভাটিতে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য তা অশনি সংকেত বয়ে আনতে পারে।
অরূপ কুমার শর্মার কথায়, ‘চীন এতদিন বলে এসেছে ব্রহ্মপুত্রের ওপর তারা যা-ই করছে, সেগুলো রান-অব-দ্য-রিভার প্রজেক্ট, অর্থাৎ নদীর জল ব্যবহার করে আবার নদীতেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই সুপারড্যাম দিয়ে তারা যে এবার ইয়ারলাং জাংবো-র জলসম্পদকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে চাইছে তাতে আর কোনও লুকোছাপা নেই।’
‘এর আগে আমরা অরুণাচল প্রদেশে বা আসামে দেখেছি ব্রহ্মপুত্রর মতো বিশাল নদ কীভাবে জায়গায় জায়গায় শুকিয়ে গেছে।’ ‘পরে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম দিয়ে প্রবেশ করার পর এই নদীরই নামকরণ করা হয়েছে যমুনা। আমার আশঙ্কা, চীনের এই সুপারড্যাম ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনার প্রবাহকে চিরতরে শুষ্ক করে দেবে’, বলছেন অধ্যাপক শর্মা।
ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মুখপাত্র সমীর সিনহাও এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, তিনি মনে করেন ভারত ও বাংলাদেশের একযোগে বিষয়টি নিয়ে চীনের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো উচিত। সাংবাদিক আশিস শুক্লা, যাকে টুইটারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ফলো করেন, তিনিও মনে করছেন, ‘চীনের এই প্রকল্প ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই উদ্বেগের’।
আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞ পবন কুমার সিং আবার একধাপ এগিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন, চীনের এই সুপারড্যামের পরিকল্পনা সামনে আসায় ভারত ও বাংলাদেশ যৌথভাবে জাতিসংঘ বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে অভিযোগ জানাতে পারে, এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে মামলাও করতে পারে।
চীন এর আগে ২০১৫ সালেই দেড়শ’ কোটি ডলারেরও বেশি খরচ করে ব্রহ্মপুত্রের ওপর জ্যাম হাইড্রোপাওয়ার স্টেশন নির্মাণ করেছে, যা বহুদিন আগে থেকেই চালু। তিব্বতে এতদিন সেটিই ছিল বৃহত্তম, কিন্তু মেডং কাউন্টিতে নির্মীয়মাণ নতুন এই সুপারড্যাম তার চেয়েও অনেক বড় আকারের হবে, খরচও হবে অনেক বেশি।
নদী বন্দর/এসএইচবি