1. badsha.dru@gmail.com : admi2017 :
  2. nadibandar2020@gmail.com : Nadi Bandar : Nadi Bandar
না খেয়ে নয়, অযত্নে মারা যাচ্ছে সৈকতের বিনোদন অনুষঙ্গ ঘোড়া - Nadibandar.com
বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩১ পূর্বাহ্ন
নদী বন্দর প্রতিনিধি:
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২ জুন, ২০২১
  • ১৫৪ বার পঠিত

নব্বই দশকের পর থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটক বিনোদনের অনুষঙ্গ ঘোড়া। হাতেগোনা কয়েকটি ঘোড়া দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও সময়ের পরিক্রমায় ঘোড়ার সংখ্যা শতকের ঘর ছাড়ায়। বিনোদনের পাশাপাশি রাজকীয় এ প্রাণি পর্যটন বাণিজ্যের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

মৌসুম ভেদে আয়ের তারতম্য হলেও পর্যটনের ৭-৮ মাসে দৈনিক গড় আয় আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা। সেই হিসাবে বিনোদন দিয়েই একটি ঘোড়ার মাসিক আয় ৭৫ থেকে ৯০ হাজার টাকা। ঘোড়ায় চড়া কিংবা ছবি তুলতে সৈকতে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের চুক্তিভিত্তিক দেয়া টাকায় এ আয় হয়।

কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, আয়ের ওপর মালিক আয়েশি জীবন কাটালেও পরিচর্যায় চরম অবহেলার খড়গ জুটে ঘোড়াগুলোর কপালে। সারাদিন আয় পেয়েও ঠিকমতো খাবারই দেয়া হয় না নিরীহ এ প্রাণিকে। ফলে ময়লা আবর্জনার উচ্ছিষ্ট ও ক্ষতিকর পদার্থ খেয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায় অনেক ঘোড়া।

jagonews24

সারাদিন সৈকতে আয়ের সময় শেষ হলে রাতে বেওয়ারিশের মতো ছেড়ে দেয়া ঘোড়াগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডাস্টবিনে খাবার খুঁজতে গিয়ে ড্রেনে পড়ে, যানবাহনের ধাক্কায় আহত হয়ে অসুস্থ হয়। পরে চিকিৎসা দিলেও অনেক ঘোড়া মারা যায়।

নব্বই দশকে সৈকতে প্রথম ঘোড়া নামানো কক্সবাজার পৌরসভার বাহারছড়া গোলচক্কর মাঠ এলাকার বাসিন্দা জানে আলম বলেন, ‘ঘোড়া রাজকীয় বাহন, উপকারী প্রাণি। তাই এর পরিচর্যাও উচ্চমার্গীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। সিনেমায় বিস্তীর্ণ বালিয়াড়িতে ঘোড়া নিয়ে দৌড়ানোর দৃশ্য বিমোহিত করায় শখের বশে ঘোড়া কিনেছিলাম। আয়ও হচ্ছে দেখে ধীরে ধীরে ঘোড়ার সংখ্যা বেড়ে ২০টি হয়েছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘোড়াকে সকাল-বিকেল ছোলা, কাঁচা খড় খাওয়াতে হয়। প্রতিদিন গোসল করানোসহ রাজকীয় পরিচর্যা দরকার। একজন মানুষ এদের পেছনে লাগিয়ে রাখতে হয়। তখন সৈকত এলাকার পর্যটন গলফ মাঠে প্রচুর খড় হতো। বিগত একযুগ আগে থেকে সেই স্থানগুলো নানা উন্নয়ন কাজে ব্যবহার হয়ে খড়ের ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়। ফলে ধীরে ধীরে ঘোড়া পালন থেকে সরে এসেছি। বাচ্চাদের শখ মেটাতে মাত্র একটি ঘোড়া পালন করছি।’

jagonews24

জানে আলম বলেন, ‘আমার আয় দেখে অনেকে ঘোড়া কিনে ব্যবসায় লাগিয়েছেন এবং এখনো লাগাচ্ছেন। কিন্তু কেউ নিরীহ এ প্রাণিকে উপযুক্ত পরিচর্যা করছেন না। সারাদিন আয় করানো ঘোড়াটি সন্ধ্যায় বেওয়ারিশের মতো ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। ক্ষুধার্ত ঘোড়াগুলো যেখানে যা পায় খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে। পর্যাপ্ত কাঁচা খড় না পেয়ে খিদা কমাতে সিংহভাগ সময় পৌরসভার ডাস্টবিনেই খাবার খুঁজে ঘোড়াগুলো। সেখানে বাসি উচ্ছিষ্ট খেয়ে অনেক ঘোড়া অসুস্থ হয় এবং মারাও যায়।’

করোনা সংক্রমণ রোধে বিধিনিষেধের কারণে কক্সবাজার সৈকতে পর্যটক নিষিদ্ধ। তাই আয় দিতে না পারায় বেওয়ারিশের মতো ছেড়ে দেয়া ঘোড়াগুলোর খোঁজ পারত পক্ষে নেয়-ই না মালিকরা। আয় দিতে পারায় যৎসামান্য যে খাবার ও পানীয় দেয়া হতো তাও বন্ধ। রাস্তা ও খোলা মাঠই ঘোড়াগুলোর ঠিকানা এখন। ফলে অযত্ন ও অবহেলায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অধিকাংশ ঘোড়া।

৫৫টি ঘোড়ার মালিকদের নিয়ে ২২ জন সদস্য বিশিষ্ট ‘কক্সবাজার ঘোড়া মালিক সমিতি’ নামের একটি সমিতি রয়েছে। সমিতির বাইরে আরও ১০টিসহ ৬৫টি ঘোড়া রয়েছে। এসব ঘোড়ার পিঠে চড়ে ও ছবি তুলে নানাভাবে বিনোদন উপভোগ করেন পর্যটকরা।

jagonews24

সমিতির দাবি, চলমান লকডাউনে ছয়টি ও গত বছর লকডাউনে ২০টিসহ মোট ২৬টি ঘোড়া খাদ্যের অভাবে মারা গেছে।

তবে দুডজনেরও বেশি ঘোড়া মারা গেলেও এ বিষয়ে কিছুই জানে না বলে দাবি করেছে প্রশাসন। কিছু গণমাধ্যমে ঘোড়ার এ অসামঞ্জস্যপূর্ণ মৃত্যু সংবাদ প্রচারের পর সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্য। বিচ সংক্রান্ত অনেকেই এত ঘোড়ার মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

সৈকতে ঘোড়া নিয়ে ব্যবসা করা পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, ‘না খেয়ে ঘোড়া মারা যাওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়। আমাদের পরিবারে চারজনের মালিকানায় ১২টি ঘোড়া ছিল। গত দুদিন আগে আমার পালিত তিনটি ঘোড়ার একটি মারা যায়। লকডাউনে ছেড়ে দেয়ার পর হয়তো কোনো ডাস্টবিনে বিষাক্ত কিছু খেয়েছিল। ঘোড়াটি রাস্তার ধারে পড়ে আছে জেনে বাড়ি নিয়ে আসি। দেড় হাজার টাকা ভিজিটে জেলা প্রাণি সম্পদের চিকিৎসক এনে পরীক্ষা করে দেখি ঘোড়াটির ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। অনেক ইনজেকশন ও পথ্য দিয়েও বাঁচানো যায়নি ঘোড়াটি।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত বছরের লকডাউনে আমাদের পরিবারের মালিকানাধীন আটটি ঘোড়া মারা যায়। তখনও ছেড়ে দেয়া ঘোড়াগুলোর কয়েকটি রাতে চলতে গিয়ে ড্রেনে পড়ে মারা গেছে। আর কয়েকটি রাতের বেপরোয়া যানবাহনের (ট্রাক-ডাম্পার-কাভার্ডভ্যান) ধাক্কায় আহত হয়ে মারা যায়।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রাণি সম্পদ অফিস থেকে ঘোড়ার পরিচর্যার বিষয়ে কখনো পরামর্শ দেয়া হয় না। কি খাওয়াতে হবে, কত পরিমাণ খাওয়াতে হবে এসব বিষয়ে আমরা অবগত নই। অনেকে ৩০-৫০ হাজার টাকায় ঘোড়া কিনে লগ্নিকরা টাকা তুলতে মরিয়া হন বলে অন্যদিকে নজর দেন না। আবার আয় না থাকলে ঘোড়ার জন্য বাড়তি খরচ করাও কষ্টকর।’

jagonews24

বিচ সংশ্লিষ্টদের মতে, সৈকতের পর্যটকদের বিনোদন দিয়ে প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমে (সেপ্টেম্বর-মার্চ) দিনে গড়ে একটি ঘোড়া দিয়ে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত মালিকরা আয় করে থাকেন। সে হিসাবে একটি ঘোড়া দিয়ে এক মৌসুমে আয় প্রায় ৫-৬ লাখ টাকা। বাকি মাসগুলোতেও কমবেশি প্রতিদিন টাকা আয় করে ঘোড়াগুলো। এর বাইরেও ঘোড়ার গাড়ি, বিয়ে ও বিভিন্ন উৎসবে ঘোড়াগুলোর ব্যবহার হয়। যার বিনিময়ে ঘোড়া মালিকরা টাকা পান।

ঘোড়ার মালিকদের তথ্যমতে, একটি ঘোড়ার খাবারের পেছনে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ হয়। সে হিসেবে বছরে লাখ খানেক টাকা ব্যয় হয় একটি ঘোড়ার পেছনে। কিন্তু স্বাস্থ্য দুর্যোগের কারণে সৈকতসহ বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকায় অন্যান্য পর্যটন ব্যবসায়ীদের মতো নিত্য আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ঘোড়া মালিকরা।

তাদের দাবি, আয় বন্ধ তাই কিনে খাবার দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় ঘোড়া রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু পর্যটন সংশ্লিষ্টদের দাবি, ঘোড়ার আয়ে মালিকদের অনেকেই গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন। গড়েছেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া প্রায় ঘোড়ার মালিকই সচ্ছল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঘোড়ার মালিক বলেন, ‘লকডাউনে খাদ্য না দিয়ে ঘোড়া রাস্তায় ছেড়ে দিলেও বেশ কয়েকজন মালিক আছে যারা মাদক সেবন ও নিজেদের জলসায় নারী এনে ফুর্তি করেন নিয়মিত। সারাদিন বাইক নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতেও দেখা যায় তাদের।’

তার দাবি, হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবারই ঘোড়াকে খাবার দেয়ার সামর্থ্য রয়েছে। এরপরও মালিকরা ঘোড়ার প্রতি অমানবিক আচরণ করছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, করোনায় আয় বন্ধ থাকার অজুহাতে ঘোড়ার খাবার না দিলেও আইপিএল ক্রিকেট নিয়ে জুয়ায় বাজি ধরে সমিতি পাড়ার দুজন ঘোড়ার মালিক লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন।

ঘোড়ার আয় দিয়ে অনেকেই জায়গা কিনে বাড়িঘর তৈরি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন স্বীকার করে ঘোড়া মালিক সমিতির সভাপতি আসান উদ্দীন নিশান বলেন, ‘আমি নিজেও ঘোড়ার আয় দিয়ে সংসারের খরচ বহনের পাশাপাশি এক ভাইকে বিয়ে করিয়েছি, বোনের বিয়ে দিয়েছি।’

jagonews24

পর্যটন মৌসুমে টানা কয়েক মাস ঘোড়া প্রতি আড়াই হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা আয়ের কথা অকপটে মেনে নিলেও আয় বন্ধ থাকায় বেশিরভাগ ঘোড়ার মালিকের খাবার যোগান দেয়ার সামর্থ্য নেই বলে দাবি করেন তিনি।

২৬টি ঘোড়া মারা গেলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কেন অবগত করা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তখন বিষয়টা সিরিয়াসলি ভাবা হয়নি।’

কক্সবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. অসীম বরণ সেন বলেন, ‘ঘোড়ার মৃত্যু নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। খাদ্যের অভাবে ঘোড়া মারা যাওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। আমার জানা মতে গত এক বছরে তিনটি ঘোড়া মারা গেছে। তাও বার্ধক্যজনিত ও নানা অসুস্থতার কারণে। কারণ আমরা ঘোড়া মালিকদের খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। আগামীতেও এ সহায়তা অব্যাহত থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এরপরও বিভিন্ন মিডিয়ায় খবরটি আসার পর প্রাণি সম্পদ অধিদফতর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে আগামী তিন কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কমিটিতে কক্সবাজার প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. নেবু লাল দত্তকে প্রধান করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন কক্সবাজার প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উপসহকারী কর্মকর্তা ডা. মিজবাহ উদ্দিন কুতুবী ও ডা. এহসানুল হক।’

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের (পর্যটন ও প্রটোকল) সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, ‘সৈকতে পর্যটকদের বিনোদনের জন্য ২২ জন ঘোড়া মালিককে অনুমতি দেয়া হয়েছে। যে পরিমাণ ঘোড়ার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। এর কোনো তালিকা আমাদের কাছে নেই। মালিকরাও কখনো এ বিষয়ে আমাদের জানায়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ রোধে সৈকত ও বিনোদনকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হলে ঘোড়া মালিকদের আয় বন্ধ হয়ে যায় এবং ঘোড়াগুলো খাদ্য সঙ্কটে পড়ে। এজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভুসি ও ছোলা বিতরণ করা হয়। খাদ্য সঙ্কট থাকার কথা নয়।’

‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ সংগঠনের কর্মকর্তা মহসীন শেখ বলেন, ‘ঘোড়ার মালিকদের অমানবিক আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ। নিরীহ প্রাণিটিকে আয়ের বাহন বানিয়ে মালিকরা লাখ লাখ টাকা আয় করেছে। কিন্তু সঙ্কটে ঘোড়াগুলোকে বেওয়ারিশের মতো ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি করা হচ্ছে। নিরীহ প্রাণির সঙ্গে এমন আচরণে ঘোড়ার মালিকদের আইনের আওতায় আনা উচিত।’

এদিকে কক্সবাজার সৈকতের ঘোড়াগুলোর খাদ্য সঙ্কটের খবরে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ৫৫টি ঘোড়ার জন্য মালিকদের হাতে এক মাসের খাদ্য সহায়তা তুলে দিয়েছে। এরপরও এখনো বেওয়ারিশের মতো ঘুরছে অনেক ঘোড়া।

নদী বন্দর / পিকে

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2020 Nadibandar.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com