যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, চৌহালী ও এনায়েতপুরে শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। গত এক সপ্তাহে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে তিন শতাধিক বসতভিটা, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। ফলে আতঙ্কে বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে মানুষ।
এদিকে সিরাজগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, ভাঙন রোধে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
সরেজমিন ভাঙন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বর্ষার শুরুতেই ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জেলার এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন।
জানা যায়, গত এক সপ্তাহে শাহজাদপুরের কৈজুরি ইউনিয়নের পাচিল ও হাট পাচিল, একই উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের পাকরতোলা ও এনায়েতপুরের ব্রাক্ষণগ্রামে তিন শতাধিক বসতভিটা এবং বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসকল এলাকার ভাঙন কবলিতরা সহায়-সম্বল হাড়িয়ে বাড়িঘর ভেঙে রাস্তার পাশে বা অন্যের জমিতে আশ্রয় গ্রহণ করছে।
এদিকে যমুনা নদীর পানির তীব্র স্রোতে চৌহালীর বাঘুটিয়া ইউনিয়নের হাটাইল, ঘুশুরিয়া, হিজুলিয়া, কাঠালিয়া ও উমারপুর ইউনিয়নের পয়লার প্রায় তিন কিলোমিটার নদী তীরবর্তী এলাকায়ও ভাঙন শুরু হয়েছে। এরমধ্যেই এ এলাকাগুলোর বিস্তীর্ণ ফসলি জমিসহ হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পশ্চিম হাটাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে হিজুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম সম্ভুদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাস মধ্য শিশুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিশ্রিগাতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বারবয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউসুফ শাহি সলঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিলজলহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাউশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শৈলজানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাটাইল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
ভাঙনকবলিত স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীতীরবর্তী সাড়ে ছয় কিলোমিটার এলাকা বরাবরই অরক্ষিত থাকে। প্রতিবছরেই এ এলাকাগুলোতে দেখা দেয় নদীভাঙন, নিঃস্ব হয় মানুষ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
নদীভাঙন কবলিত কৈজুরি ইউনিয়নের পাচিল গ্রামের কালাম ফকির বলেন, ‘পৈত্রিক সূত্রে ১১ বিঘা ফসলি জমি ও তিন বিঘার একটি বসতবাড়ি পেয়েছিলাম। বাড়িতে অন্তত ১৫টি দুধেল গাভী ছিল। গত কয়েকবছর যাবত ভাঙনে সবই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে’।
‘গত শনিবার (২৯ মে) আমার শেষ সম্বল ৪০ কাঠার ফসলি জমি আর বসতভিটা একসঙ্গে ভাঙতে শুরু করেছে। নিঃস্ব হয়ে পথে নেমে গেলাম’।
তিনি আরও বলেন, ‘তিন বছর আগে আমার জমি যখন ভাঙা শুরু হয় তখন থেকেই শুনছি নদীতে বাঁধ দেয়া হবে। কিন্তু আজও কাজ শুরু হলো না। অথচ এদিকে আমার সব শেষ হয়ে গেল’।
এনায়েতপুরের ব্রাক্ষণগ্রামের আবুল সরকার বলেন, ‘কিছুদিন আগে স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রী এসে বলে গেল এ এলাকার আর এক টুকরো জমিও নদীতে যেতে দেয়া হবে না। অতিদ্রুত বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে। কোনো কাজ শুরুতো দূরের কথা কেউ খোঁজ নিতেও আসেননি’।
জালালপুরের পাকরতোলা গ্রামের চায়না বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ছিল কৈজুরির পাচিলে। সেখানে ভাঙনে বসতভিটা নদীতে চলে যাওয়ায় পাকরতোল এসে এক আত্মীয়ের জমিতে ঘড় তুলেছি। এখন এ বাড়িও নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। দুবছর আগেও ছিল গোয়ালভড়া গরু, ছিল গোলাভরা ধান, এখন আমরা নিঃস্ব। সরকার কোনো সহযোগিতা না করলে আমাদের আর কোনো উপায় নেই’।
সিরাজগঞ্জের পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, এনায়েতপুর থেকে কৈজুরি পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি দ্রুতই অনুমোদন পাবে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে এ এলাকায় আর ভাঙন থাকবে না।
তিনি আরও জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার মহোদয়ের পরামর্শে ভাঙনরোধে জরুরি ভিত্তিতে চর কেটে নদীর স্রোত পরিবর্তনের জন্য ২৬ ইঞ্চি একটি ড্রেজার আনা হচ্ছে। ড্রেজারটি পৌঁছালে দ্রুত চর কেটে দেয়া হবে। এতে ভাঙন থেমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নদী বন্দর / পিকে