বছরের পর বছর কেটে গেলেও মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌরুটের লঞ্চ সার্ভিসের দৈন্যদশা কাটছে না। একদিকে পুরাতন লক্কড়-ঝক্কড় লঞ্চ, অন্যদিকে শীতলক্ষ্যা নদীতে যত্রতত্র নোঙর করা কার্গো। ফলে প্রতিদিন বিপদের ঝুঁকি নিয়েই এ রুটে যাতায়াত করতে হচ্ছে যাত্রীদের। তার ওপর অতিরিক্ত যাত্রী, আর অদক্ষ চালক তো রয়েছেই।
সম্প্রতি দুর্ঘটনায় ৩৫ জনের মৃত্যু হলেও এ নৌরুটে লঞ্চ সার্ভিস উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই। সামনে বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বৃদ্ধি ও বৈরী আবহাওয়ায় বিপদের আশঙ্কা আরও বাড়ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা যায়, এই নৌরুটে বর্তমানে ২৪টি লঞ্চ রয়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬-৭টা পর্যন্ত ২০ মিনিট পর পর লঞ্চ ছেড়ে যায়। এসব লঞ্চে প্রতিদিন হাজারো যাত্রী চলাচল করে। এর মধ্যে অধিকাংশ যাত্রী মুন্সিগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা যাতায়াত করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ লঞ্চের কাঠামো ও ইঞ্জিন খুব পুরোনো। জোড়াতালি আর রঙের প্রলেপ দিয়ে পুরোনো লঞ্চকে নতুন করে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে।
সরজমিনে মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাটে দেখা যায়, ধলেশ্বরী থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর প্রবেশ মুখেই সারি সারি কার্গো জাহাজ নোঙর করা। মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌরুটের ছোট ছোট লঞ্চগুলোকে এসব বিশাল বিশাল জাহাজ পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। এতে লঞ্চের গতি কমিয়ে আনায় চলাচল বিলম্ব হয়। যেকোনো সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ার শঙ্কা তো রয়েছেই।
এদিকে এসব লঞ্চগুলোর অবস্থা জীর্ণদশা। রঙের প্রলেপ লাগিয়ে নতুন লঞ্চ বুঝানোর চেষ্টা করা হলেও স্টিলের কাঠামোতে স্থানে স্থানে জং ধরছে। অধিকাংশ লঞ্চে নেই আরামদায়ক চেয়ারের ব্যবস্থা। নদীতে ঢেউয়ে দোল খায় লঞ্চগুলো। এতে যেকোনো সময় উল্টে যেতে পারে। এর মধ্যে ইঞ্জিন পুরাতন, এতে চলাচলে সময় লাগে বেশি। কোন কোনটিতে কম সংখ্যক যাত্রী নেয়া হলেও অধিকাংশেই নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত যাত্রী।
এ বিষয় কথা বললে যাত্রীরা করেন বিস্তর অভিযোগ। কলেজ ছাত্র বোরহান উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী এই নৌরুটের লঞ্চ সার্ভিস ব্যবহার করে। তবে লঞ্চে নূন্যতম সুবিধা নেই। নিচতলার থেকে উপর তলায় ভাড়া বেশি। কিন্তু বসার সিট একই রকম।
মাসুম বিল্লাহ নামের আরেক যাত্রী বলেন, সড়কপথ খারাপ দেখেই এখনো অনেকে বাধ্য হয়ে লঞ্চ ব্যবহার করে। নয়তো এসব লঞ্চ কেউ ব্যবহার করতো না।
আকলিমা আঁখি নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, সবকিছুর উন্নয়ন হয়। কিন্তু মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জের লঞ্চের উন্নয়ন হয় না। আর মাঝ নদীতে একটার পর একটা জাহাজ তো আছেই। পাশ কেটে যেতে গিয়ে কবে যে সলিল সমাধি হয়।
স্থানীয় সাংবাদিক জুয়েল রানা বলেন, বহু বছর যাবত এমন অবস্থা। যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে চরম। জেলাবাসীর সকলের দাবি এ নৌরুটের লঞ্চগুলো পরিবর্তন করা হউক, আর যাত্রী সেবা বাড়ানো হউক।
এ ব্যাপারে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ মালিক সমিতির সদস্য দীন মো. কোম্পানি বলেন, কার্গো জাহাজগুলো সরানোর জন্য আমরা জোর দাবির পরও এগুলো সরানো হচ্ছে না। একটা জাহাজ আড়াইশ-তিনশ ফিট লম্বা। নদীতে অনেক জায়গা দখল করে রাখে। কিছুদিন আগে একটি লঞ্চ ডুবল। তারপরও এই অবস্থায়। প্রশাসন তো আমাদের দেখেই না।
তিনি আরও বলেন, লকডাউনের পর লঞ্চে যাত্রী কমে গেছে। একটা লঞ্চে বড় জোর ১০-২০ জন যায়। তেলের পয়সাও উঠে না। সরকার যদি অনুমতি দিতো তাহলে আমরা লঞ্চগুলোকে বড় করতাম ৬৫ ফুট, ৭০ ফুট করতাম। যাত্রীদের সুবিধা বাড়ত। নতুন ইঞ্জিনে ২৫ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া যেতো। তখন যাত্রীরা আবার নৌরুটই ব্যবহার করতো। আমরা তো ভালো সার্ভিসের জন্য প্রস্তুত। মালিক সমিতি থেকে বারবার বলার পরও আমাদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না।।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের উপপরিচালক বাবু লাল বৈদ্য বলেন, নৌরুটে ২৫টি লঞ্চের মধ্যে ১টি ডুবে গেছে। বর্তমানে ২৪টি আছে। মুন্সিগঞ্জ ঘাটে আমাদের কোনো লোকজন নেই। তবে নারায়ণগঞ্জ থেকে যখন লঞ্চ ছাড়া হয় কিংবা মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসে সেগুলো মনিটরিং করা হয়। যাতে সেসব লঞ্চ সঠিকভাবে চলাচল করে। আমাদের বলার পর এরমধ্যে মতলব রুটের কয়েকটি বড় লঞ্চ এ সার্ভিসে যুক্ত করেছে মালিকরা। তবে তারা এখনো সময় সূচি পায়নি। আমরা যাচাই-বাছাই করে সময় সূচি দেব।
তিনি আরও বলেন, আমরা যখনই কোনো আবহাওয়া খারাপ দেখি, তখনই লঞ্চ বন্ধ করে দেই। বৈরী আবহাওয়া দূর না হওয়া পর্যন্ত লঞ্চ বন্ধ থাকে। ফিটনেসের বিষয়টি নৌপরিবহন অধিদফতর দেখে। তারাই মাপ, সার্ভে, রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেসের বিষয়টি দেখে। আমরা কেবলমাত্র লঞ্চগুলোর সময়সূচি দেই।
যত্রতত্র কার্গো নোঙরের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে জরুরি সভা করেছি। বিআইডাব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে কয়েকদিন আগেই মিটিং হয়েছে। আমাদের ইন্সপেক্টররা গিয়ে কার্গো জাহাজ সরিয়ে দেয়। নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যত্রতত্র পার্কিং না করে যেন বিনস্তভাবে নদীতে কার্গো রাখা হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। এরপরও যারা নিয়ম মানছে না তাদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রতি মাসেই ১০-১৫টি মামলা করা হচ্ছে।
নদী বন্দর / জিকে